উন্নয়ন নাকি ষড়যন্ত্র
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। ২০০৯ সালে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার বা ২৪ হাজার থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হলেও নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই কয়েক ধাপে ব্যয় বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার বা ১ লক্ষ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। আজ স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে এর মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ কোটি বা ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ করতে হবে যা আগামী ২৮ বছরের মধ্যে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক ঋণ ১৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। মাত্র ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এর সঙ্গে ১২ বিলিয়ন ডলারের এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ যুক্ত হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে নিশ্চিত।
৪. বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম কত হবে তাও নিশ্চিত নয়। গত ২৫ ডিসেম্বর এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সইয়ের পর জানানো হয়েছিল, প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে সাড়ে পাঁচ টাকা। আবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবে রূপপুর কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সাড়ে সাত টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বৃটিশ নিউক্লিয়ার ইনস্টিটিউটের ফেলো ও ইউরোপে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নিউক্লিয়ার সাইনটিস্ট এ. রহমান এর হিসাব অনুসারে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টটি চালু হলে প্রতি ১৮ মাস পর পর মেইনটেনেন্স ও রিফুয়েলিং এর জন্য ৩ মাসের জন্য শাটডাউন করতে হবে। এর জন্য প্রতিবার খরচ হবে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রটি যতদিন চলবে, প্রতিবছর অপারেটিং কস্ট পড়বে ৫০ মিলিয়ন ডলার করে। চুক্তি অনুযায়ী কনস্ট্রাকশন খরচ ১২.৬৫ বিলিয়ন বলা হলেও এর খরচ আরও বাড়বে। চুক্তির মডেলটি ‘কস্ট প্লাস’ অর্থাৎ রাশিয়া সময়ে সময়ে খরচ বাড়িয়ে নিতে পারবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ঋণের সুদ। ডিকমিশনিং এর খরচ নির্মাণ খরচের প্রায় কাছাকাছি পড়ে। সবমিলিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে কমপক্ষে ৮.৫০ টাকা।
৫. নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উপজাত হিসেবে যে বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলো তেজষ্ক্রিয় এবং এর তেজষ্ক্রিয়তা কমে সহনীয় পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে ১০,০০০ বছর লাগবে। তার মানে নিউক্লিয়ার বর্জ্যকে সরিয়ে আমাদের এমন কোথাও রাখতে হবে যা ঝুঁকিহীন থাকবে টানা দশ হাজার বছর। অতএব এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকিটা কেবল আমাদেরই থাকছে না, ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যও। বলা হচ্ছে, রাশিয়া এই বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট চুক্তি এখনও স্বাক্ষর হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে সুদূর রাশিয়ায় নিরাপদে এই বর্জ্য কিভাবে নিয়মিত পরিবহন করা হবে সে বিষয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
৬. কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও স্বাভাবিক অবস্থাতেই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রতিবছর বায়ুমন্ডলে ও পানিতে নানাভাবে তেজষ্ক্রিয়তা ছড়ায় যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে চারপাশের ৩০ কি.মি. ব্যাসার্ধ জুড়ে বসবাসরত অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রস্তুতি বা বাস্তবতা বাংলাদেশে নেই। আরও দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা ও দুর্নীতি থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দিয়ে ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিল ২০১৫’ নামের আইনও পাশ হয়েছে।
পাবনার রূপপুরে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় পাকিস্তান আমলে, ১৯৬১ সালের দিকে। সে সময় ৭০ মেগাওয়াটের একটি ছোট আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা ভাবা হয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়। এর মধ্যে ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মায় পানি কমেছে, রূপপুরে জনবসতি বেড়েছে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে নানান দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি স্পষ্ট হয়েছে কিন্তু পাকিস্তান আমলের পরিকল্পনা আরও বড় আকারে স্বাধীন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করার তৎপরতা চলছে। এর জন্য কোনো অর্থনৈতিক সমীক্ষা, পরিবেশ সমীক্ষা ইত্যাদি জনগণের কাছে উন্মোচিন করা হয়নি, হয়নি বিপুল আর্থিক দায় ও পারমাণবিক ঝুঁকি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক। এর মধ্যেই একের পর এক চুক্তি স্বাক্ষর করে চলেছে সরকার রাশিয়ার সঙ্গে।
‘আপনারা তো সব প্রকল্পেরই বিরোধিতা করেন’Ñ এরকম কথা যারা বলতে চান, তাদের উদ্দেশে আমাদের বক্তব্য হলোÑ আমরা সব প্রকল্পের বিরুদ্ধে নয়, সব প্রকল্পের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও লুণ্ঠনের বিরোধিতা করি। প্রশ্নটা বরং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের করা দরকারÑ কেন আপনাদের সব প্রকল্পে এত অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা থাকে, এগুলো যদি উন্নয়ন প্রকল্পই হয়, তাহলে জনগণ কেন এসবের বিরোধিতা করছে? বাস্তবে বাংলাদেশের জনগণ সব প্রকল্পের বিরোধিতা করেÑ এ কথাটি সঠিক নয়। দেশে এতগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত্ব গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে, কই কেউ তো বিরোধিতা করেনি। এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বড়পুকুরিয়ায় ছোট আকারের যে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে সেটার বিরুদ্ধেও কোনো আন্দোলন হয়নি।
বস্তুত, জনগণের বিরোধিতা মুখে শুধু বাঁশখালী বা রামপালেই নয়, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিভিত্তিক একটি দেশের কোথাও এত বড় আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হবে না।
লেখক : প্রকৌশলী ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন