জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে ক্রসফায়ার কি অনিবার্য?
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
সপ্তাহখানেক আগে ফেসবুকে মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যা প্রচেষ্টাকারী জঙ্গি ফাহিমের তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে ‘আপনি তো ছাগু নন, বস’ শীর্ষক একটা ব্যঙ্গাত্মক স্ট্যাটাস দিতেই ক্রসফায়ারের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার এই একটা সমস্যা! এক স্ট্যাটাসে তো আর সবকিছু আলোচনা করা সম্ভব না, কিন্তু মন্তব্যকারীরা যে যার মতো বলতে থাকেন। এই স্ট্যাটাসটি পড়ে অনেকেই আবার বিস্মিত হয়েছেন। তাদের ধারণা, আমি বোধ হয় ক্রসফায়ারের সমর্থক! ইউরোপ থেকে এক বাঙালি তরুণী আবেগাক্রান্ত হয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, পুলিশ প্রহরায় থাকা হাতকড়া পরিহিত একটি আঠারো বছরের যুবকের তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হবার খবরে কি আমার খারাপ লাগেনি? আমার আর তাকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়নি, একজন কলেজ শিক্ষককে হত্যার জন্য আঠারো বছরের ফাহিম যখন চাপাতি হাতে কোপায়, তখন কি সেই শিক্ষকের জন্য আপনার কষ্ট হয় না? দরদ যত সব ওই খুনিদের জন্য? তবে স্ট্যাটাসে প্রদত্ত বিভিন্ন মতামতের প্রেক্ষিতে গত কয়েকদিন ধরেই তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি, এই নিয়ে পড়াশুনাও করেছি।
ক্রসফায়ার টুকটাক চললেও ২০০৪ সালে, তৎকালিন জামায়াত-বিএনপির আমল থেকে র্যাবের তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। সেই থেকে প্রায় প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের পরে একই ধরনের কাহিনী প্রচার করা হয়, যার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুরু থেকেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ স্বস্তিবোধ করলেও বিচার বহির্ভূত এধরনের হত্যাকা- মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বরাবরই সমালোচিত হচ্ছিল। একজন মানুষ অপরাধী সাব্যস্ত হলে তাকে আইনের আওতায় শাস্তি প্রদান করা হবে, এটিই সবার কাম্য। আমি নিজেও ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ হত্যার বিরোধী। শুরু থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে সন্ত্রাসী এবং চরমপন্থিদেরই মূলত হত্যা করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ক্রসফায়ারের হাতেগোনা কিছু ঘটনা ঘটলেও তার সংখ্যা খুবই নগন্য। বাংলাদেশে শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাইদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের উত্থানও হয়েছিল বিগত জামায়াত-বিএনপি সরকারের আমলেই। তবে সাম্প্রতিক কতিপয় ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা বাদ দিলে ইতোপূর্বে যে সতেরশ’র বেশি ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে জঙ্গিদের সংখ্যা দশজনও হবে না। গত কয়েক বছরে জেএমবি, এবিটি, হিযবুত তাহরিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে গিয়ে বহু জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কেউ কেউ এখনও কারাগারে বন্দী থাকলেও অনেকেই জামিনে বেরিয়ে গিয়ে পুনরায় জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে অনেকেই আইনের সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন। গত দুই মাসে শুধু চট্টগ্রামেই বিশজন সন্ত্রাসের অভিযোগে বন্দী জঙ্গি কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছে। প্রচলিত আইন তাদের কারাগারে বন্দী করে রাখতে পারছে না, ফাঁক-ফোকড় গলে তারা বেরিয়ে পড়ছেন।
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস করছে, তারা সাধারণ সন্ত্রাসীদের চেয়ে ভিন্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা যে সংগঠনের নামেই মাঠে সক্রিয় থাকুক না কেন, এদের রাজনৈতিক গডফাদার হলো জামায়াত-শিবির। আর জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কটাও সবার জানা। এ পর্যন্ত যত জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়েছে, তার অধিকাংশই শিবিরের সাবেক কর্মী। যে কারণে সরকার যখনি জঙ্গি দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়, তখনি বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযানের বিরোধিতা করে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়।
লেখক : কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন