আবারও ঝিনাইদহে সেবায়েত হত্যা
দীপক চৌধুরী (ঢাকা), রোকনুজ্জামান মিলন ঝিনাইদহ ও মো. ইমরান হোসেন, নড়াইল: ঝিনাইদহ সদরে মন্দিরের এক সেবায়েতকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত শ্যামানন্দ দাস ওরফে বাবাজি (৫৫) সদর উপজেলার উত্তর কাষ্টসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধামদন গোপাল মঠের সেবায়েত। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। নিহত শ্যামানন্দ দাস বাবাজি নড়াইল সদর উপজেলার মুসুড়িয়া গ্রামের কিরণ দাসের ছেলে।
ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানিয়েছেন, সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস ৩ বছর আগে ঝিনাইদহের উত্তর কাষ্টসাগরা শ্রী শ্রী রাধামদন গোপাল মঠ মন্দিরে আসেন। এরপর থেকে মঠের সেবায়েত হিসেবে কাজ করছিলেন। প্রতিদিনের মতো গতকাল সকালেও পূজা দেয়ার জন্য মন্দিরের পাশেই তিনি ফুল তুলছিলেন। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে ৩ জন দুর্বৃত্ত এসে তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নাম প্রকাশ না করে এক নারী প্রত্যক্ষদর্শী জানান, প্রতিদিনের মতো আজও (শুক্রবার) পূজার জন্য ফুল তুলতে মঠ থেকে বের হয়েছিলেন শ্যামানন্দ। তিনি ফুল তুলতে যাবেন এ সময় শহরের দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে করে আসা তিন ব্যক্তি শ্যামানন্দকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে চলে যায়। মোটরসাইকেলের আরোহীদের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। মাথায় ছিল ক্যাপ। মাঝেরজনের হাতে ছিল একটি রামদা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, শ্যামানন্দ হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকায় শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
মঠ পরিচালনা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মণি কুমার রায় বলেন, গত তিন বছর ধরে সেবায়েতের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন শ্যামানন্দ। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। পূজা-অর্চনায় সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। তার বাইরে যাওয়া-আসা খুব কম ছিল।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রাজ কুমার জানান, ভোরে মঠের গেটের পাশে গাছ থেকে ফুল তুলছিলেন শ্যামানন্দ দাস। এ সময় তিনজন মোটরসাইকেল আরোহী মঠের সামনে আসেন।
শ্যামানন্দ দাসের বড়ভাই সুধাংশু সরকার বলেন, একজন সংসারত্যাগী সৈন্যাশীর যার কোনো শত্রু নাই তাকে এভাবে মরতে হলো, তাহলে আমাদের কী হবে। এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
দুর্বৃত্তরা তার ঘাড়ে, পিঠে ও বুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। মোটরসাইকেলের আরোহীদের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। মাথায় ছিল ক্যাপ। মাঝেরজনের হাতে ছিল একটি রামদা। এ ঘটনায় স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলতাফ হোসেনসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। এসপি সাংবাদিকদের বলেন, কিছুদিন আগে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি হত্যার সঙ্গে এই হত্যাকা-ের সাদৃশ্য রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। জানতে চাইলে তিনি আমাদের অর্থনীতিকে আরো বলেন, হামলাকারী ঘাতকদের শিগগিরই আমরা ধরতে পারব। ইতোমধ্যে হত্যাকারীদের ব্যাপারে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে শ্যামানন্দকে গুরুতরভাবে জখম করে। ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। তার লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কে বা কারা এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
‘চাক্ষুস সাক্ষী রয়েছে বলেই শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে’ : ঝিনাইদহ সদরের হিন্দু মন্দির শ্রীশ্রী রাধামদন গোপাল বিগ্রহের (মঠ) সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে কুপিয়ে হত্যার চাক্ষুস সাক্ষী রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি জানান, এ ঘটনায় জড়িতদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় যারা সম্পৃক্ত তাদের আমরা ধরে ফেলতে পারব। আমাদের চাক্ষুস সাক্ষী রয়েছে।
যেভাবে যে কৌশলে এই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে, তার সঙ্গে সাম্প্রতিক বিভিন্ন জঙ্গি হামলা ও হত্যার ঘটনার মিল রয়েছে। সাম্প্রতিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি রয়েছে জানিয়ে শ্যামানন্দ দাসের ঘাতকদের আটক করার আশা প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের গতিবিধি আমরা অনেক আগের থেকেই পর্যবেক্ষণ করছি। কাজেই আমরা মনে করি এটা (খুনিদের ধরতে) আমরা পারব।
গ্রামের বাড়িতে মৃতদেহ নেওয়া হয়নি : ঝিনাইদহের মধুপুর মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসের বাড়ি নড়াইল সদরের কলোড়া ইউনিয়নের মুশুড়ি গ্রামে চলছে শোকের মাতম। মঠ থেকে লাশ আসবে এ খবর শোনার পর তার স্বজনেরা এক নজর দেখার অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাশ আর নড়াইলে নিজ বাড়িতে আনা হয়নি।। তবে এলাকাবাসী অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার লাশ গ্রামের বাড়িতে না দেওয়ায়।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নির্বাক মা চারুবালা সরকার জানেন না তার ‘আদরের ছোটমনি’ চলে গেছে না ফেরার দেশে। মাকে বলা হয়েছে তিনি অসুস্থ হয়েছেন।
চার ভাই এক বোনের সবার ছোট ছেলেকে আদর করে গ্রামের সকলে ‘ছোটমনি’ বলে ডাকত। শ্যামানন্দ দাসের প্রকৃত নাম প্রদ্যুৎ সরকার। মঠে যেয়ে শ্যামানন্দ দাস নাম ধারণ করে বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানান। শ্যামানন্দ দাসের অকালে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না এলাকাবাসী। এলাকাবাসী এ হত্যাকা-ের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান। ১৩ বছর বয়সে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর টানে তিনি ঝিনাইদহ যেয়ে মঠে ধর্মের সেবায় কাজ করতেন। মাঝে মধ্যে এলাকায় আসতেন এই বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম