সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় দৃশ্যমান অগ্রগতি শূন্য
দীপক চৌধুরী : জঙ্গিদের ‘অপ্রতিরোধ্য’ তৎপরতায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনে দৃশ্যমান সক্রিয়তা নেই। ছয়মাসে হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ছয়জনকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, র্যাব হেডকোয়ার্টার্স পৃথক বৈঠক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয় কিন্তু অপরাধী গ্রেফতারে কার্যকর অগ্রগতি হয়নি এখনো।
ঝিনাইদহে সদরে মন্দিরের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত ব্যক্তি সদর উপজেলার উত্তর কাষ্টসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধামদন গোপাল মঠের সেবায়েত। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঘটনাটি ঘটে।
গতমাসে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যা প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকে ইঙ্গিতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার কাছে এসব গুপ্তহত্যার তথ্য আছে’Ñ একথা বলার পর প্রায় প্রতিটি বৈঠকে সন্দেহযুক্ত জেলায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বাড়াতে জেলার পুলিশ সুপারদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক। সরকারের উচ্চমহলের পরামর্শ অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলার পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকদের সারাক্ষণ দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কড়া পরামর্শ তার। যেকোনো সহিংস ঘটনা বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ হামলার শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নিতে জেলার এসপি ও ডিসিকে নির্দেশ দেন সিনিয়র স্বরাষ্ট্র সচিব।
গত একমাসে এসব হত্যাকা-ের তদন্তকালে সম্ভাব্য ৬জন আসামি ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা ধারণা করেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ও বিতর্কিত করতেই সাম্প্রতিক হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে।
নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি ও ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত হত্যার পর সপ্তাহ না কাটতেই পাবনায় অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-ে এবং গতকাল আরেক সেবায়তে শ্যামানন্দকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যাকা-ের ধরন দেখে স্থানীয় পুলিশ বলছে, শ্যামানন্দকে পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়। ঘাড়ে ও মাথায় এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে দেখে মনে হয় খুনিরা তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিল।
গত ৭ জুন ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী, ৫ জুন নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ এবং একই দিনে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে খুনের ওই ধরনে। চলতি বছর কেবল ঝিনাইদহে একই কায়দায় তিনজন ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হলো। প্রথম ঘটনা ঘটে গত ৭ জানুয়ারি। ওই দিন ঝিনাইদহের সদর উপজেলার বেলেখাল বাজারে নিজ হোমিও চিকিৎসালয়ে খুন করা হয় ছামির আলীকে (৮২)। পরদিন আইএসের নামে দায় স্বীকার করে দাবি করা হয়, খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে ছামির আলীকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ১৪ মার্চ কালীগঞ্জ উপজেলায় শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা আবদুর রাজ্জাক (৪৮) নামের এক হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই হত্যার দায়ও স্বীকার করে আইএস। এ দুটি হত্যা ঘটনার তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপটে পুলিশ দেশজুড়ে জঙ্গি দমনে সাতদিনের ‘সাঁড়াশি অভিযান’ পরিচালনার পর প্রথম সকালেই পাবনায় খুন হলেন নিত্যরঞ্জন।
দলের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্যের অভিমতÑ অপ্রিয় হলেও সত্য, এখন সরকার মানেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের ভরসাস্থল। সুতরাং তাকে বিপদে ফেলতে সংখ্যালঘু অঞ্চলে দুর্ঘটনা বা হানাহানি ঘটিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। তবে সরকার সতর্ক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ক্রসফায়ার ছাড়া চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের তদন্তে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই দীর্ঘ একমাসেও। সাম্প্রতিক অভিযানে বা এর আগে গ্রেফতার করা সন্ত্রাসী বা জঙ্গিরা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও দৃশ্যত আলোচিত হত্যামলার আসামি গ্রেফতার হয়নি। বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে পুলিশ।
কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে ছিনতাই চাঁদাবাজি ঠেকাতে পুলিশকে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিয়ে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, তার বাহিনীর সদস্যরা আইনের মধ্যে থেকে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এতে তিনিও সমালোচিত এখন।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে কথিত বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনার সমালোচনা করে ক্ষমতাসীন দলের অংশীদার মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘ক্রসফায়ার’ এই সমস্যার সমাধান নয়, বরঞ্চ তাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা-ব্যর্থতা ফুটে উঠছে।
জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কমছে না। অপরাধী গ্রেফতারে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তোড়জোর দেখালে বাস্তবে চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকা-ে গ্রেফতার নেই – এটা মেনে নিতে রাজি নয় পুলিশ কর্মকর্তারা।
একটি সূত্র জানায়, সরকার থেকে উদ্বেগ ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে বলা হলেও পরিবেশ সংখ্যালঘুদের স্বস্তি দেয়নি এখনও।
গত ৭ জুন ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী, ৫ জুন নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ এবং একই দিনে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাছাড়াও উল্লেখযোগ্য ১০ জুন পাবনা সেবাশ্রমের কর্মী নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তিনি জেলার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী অনুকুল চন্দ্র ঠাকুর সেবাশ্রমের সেবক। প্রায় ৪০ বছর ধরে পাবনার এই আশ্রমে সেবক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।