ঈদের পরে গ্রেফতার হতে পারেন এসপি বাবুল
বিপ্লব বিশ্বাস : পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করলেও তা এখনো গ্রহণ করেনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তবে যেকোনো সময় তা গ্রহণ করে পর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। কেন না চট্টগ্রামে পুলিশের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে প্রমাণ হয়েছে স্ত্রী হত্যায় বাবুল আক্তার জড়িত। তার পরিকল্পনাতেই মিতুকে হত্যা করা হয়।
সূত্র মতে, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায় বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে রুদ্ধদার বৈঠকে বসেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সরকারের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্তা-ব্যক্তিও। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় এসপি বাবুলের গ্রেফতারের বিষয়ে। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করে, বাবুল যদি অপরাধী হন, তাহলে প্রচলিত আইনে তার সাজা হওয়া উচিত। আরেকটি অংশ মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাবুল সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষায় তার সরে যাওয়া উচিত। বাবুল আক্তারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন এখনো মনে করেন, বাবুল স্ত্রী হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন না। বাবুলের পদত্যাগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গত শনিবার বাসায় আসার পর থকে বাবুল এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বাবুল বাসায় ফেরার পর গত রোববার থেকে তার বাসার সামনে পুলিশের নিরাপত্তাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার রাতে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর তিনজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা বাবুলকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে সময়ই তার পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হয়। তবে পদত্যাগপত্রটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ সদর দফতরে জমা পড়েনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় মাহমুদা হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে দাবি করে তিন ডিআইজি বাবুলকে দুটি বিকল্প দেন। বাবুলকে বলা হয়, তাকে বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে, নইলে তাকে মাহমুদা হত্যা মামলায় আসামি হতে হবে। বাবুল বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেন। বাবুলের ঘনিষ্ঠ একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঊর্ধ্বতনের চাপের মুখে বাবুল বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। এ ছাড়া তার আর কিছু করার ছিল না। কেননা পুলিশের মতো বাহিনীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
ওই কর্মকর্তাদের একজন বলেন, আমরা স্যারদের বলেছি, কোনো মাঝামাঝি পন্থা থাকতে পারে না। মাহমুদা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। বাবুল যদি এতে জড়িত হন, তাহলে অন্য আর দশজন অপরাধীর যা হয়, তারও তা হবে। আর তা না হলে তিনি সসম্মানে পুলিশ বাহিনীতে থাকবেন। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
তবে গত কয়েকদিন ধরে মিতু হত্যার নায়ক মুছা কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে, তা নিয়েই অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে রহস্যময়তা। শুরুতে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, মুছা পুলিশের কাছেই আটক আছে। কিন্তু পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুছাকে ধরার চেষ্টা চলছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুছাকে ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত আছে। সে ছাড়াও অন্য যে ৫ জনের নাম এসেছে, তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য দেশের সব বিমান ও স্থল বন্দরে অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। তবে পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, মুছা বর্তমানে তাদের হেফাজতে আছেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিতু হত্যাকা-ের আরও পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের মধ্যম গাগরা গ্রামে কামরুল ইসলাম ওরফে আবু মুছা সিকদারের বাড়ি। মুছা ২০০০ সালে সৌদি আরব যায়। তবে একই বছর আবার দেশে ফিরে আসে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপির স্থানীয় ক্যাডারদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ক্যাডারদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। স্থানীয় পা-াদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকার কারণে হাটহাজারী সার্কেলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জাহাঙ্গীর মাতুব্বর তাকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেন। সেখানে এএসপি হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বাবুল আক্তারের সঙ্গেও কাজ করে মুছা।
এছাড়া রাঙ্গুনিয়ার জসিম বাহিনীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে মুছার। স্থানীয়রা জানান, এক-এগারোর সময় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুছা আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়। তবে ওই সময় তার নামে থানায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। ২০০৮ সালের পর মুছা চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। চট্টগ্রামে এহতেশামুল হক ভোলার (মিতুকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার) সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ শুরু করেন। সোর্স হিসেবে পুলিশের সঙ্গে তার সম্পর্কও বজায় ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মিতু হত্যাকা-ের পর রাঙ্গুনিয়ায় মুছার পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা গা ঢাকা দিয়েছে। স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, মিতু হত্যাকা-ের সঙ্গে মুছার সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ হওয়ার পরপরই তার পরিবারের সদস্যরা একেবারে হাওয়া হয়ে গেছে।
এদিকে বৈঠকের খবর সূত্রে শোনা গেছে, ঈদের আগে নয়-ঈদের পরে গ্রেফতার করার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একমত পোষণ করেন। মিতুর দুই সন্তানের মানবিক দিক বিবেচনা করে এ সিন্ধান্ত নেওয়া হয় বলেও জানা গেছে। এ সময় বাবুল-মুছার ফোনালাপের কথোপকথন, মুছার স্ত্রীর সঙ্গে বাবুলের ঘনিষ্ঠতা, গ্রেফতারের পর জনগণের প্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম