নতুন অক্ষে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী আক্রমণ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এটা অনভিপ্রেত হলেও যারা ভাবছেন এমনটি হবার কথা ছিল না, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
শাহবাগ গণজাগরণ আন্দোলনের প্রাক্কালে ব্লগার রাজীব হত্যার পর হতে বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তমনা, লেখক, প্রকাশক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুরোহিত, গৃহবধূ হত্যা ঘটনাগুলোর সুরাহা করতে না পারা কিংবা ধর্মের গোঁড়ামীকে কেন্দ্র করে ঘটনার জটিলতা অনুধাবন করলেও তার মূলে পৌঁছাতে না পারার খেসারত দিতে হলো ঢাকার সুরক্ষিত গুলশানের ‘হলি আর্টিজান বেকারী’র নৃশংস সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্য দিয়ে।
এখনও আমাদের রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে দ্বিধা বিভক্তি আছে ঘটনার জন্য কোনো পক্ষ দায়ী তা স্পষ্ট করতে। খালি চোখে এটা বলাই যায়, এই সন্ত্রাসী আক্রমণ যারা চালাচ্ছে তাদের এজেন্ডা এই দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা কেউ বলছেন এটা আল-কায়েদার কাজ আবার কেউ যুক্তি দিচ্ছেন এটা আইএস। অনধিক ৪০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করা ৬ হতে ৮ জনের সন্ত্রাসী দল যখন প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশের সঙ্গে কোনো আলোচনায় রাজি হলো না, তখন ধারণা করা হচ্ছিল আইএস এই প্যাটার্নে কাজ করে। কিন্তু আইএসের ওয়েবসাইটে এই হামলার দায় স্বীকার করার পরও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না এরা কারা। পরবর্তীতে মিডিয়া সূত্র নিশ্চিত করেছে, গুলশানের সন্ত্রাসীরা আইএসের ভাবশিষ্য। ইস্তাম্বুল, জর্ডান, সিরিয়া, প্যারিসে ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনার সঙ্গে এরাও জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত। প্রমাণিত হলো গত কয়েক বছরের চারাগাছটি এখন বৃক্ষে পরিণত হয়ে নিজস্ব পরাগায়নের জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের নতুন প্রজননের ক্ষেত্রভূমি। তার ডালপালা এখন আরও বড় কোনো ঝড়ের ধাক্কা সামলাতে প্রস্তুত।
আশার বিষয়, তাদের বিপক্ষে প্রথম যুদ্ধে আমাদের জয় হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এ জন্য আমাদের সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবকে দেশবাসীর পক্ষ হতে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। ১৩ জন জিম্মিকে উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা হয়েছে। যৌথবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে তারা সমস্যার মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু ২০ জন সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করা যায়নি। যা এক অর্থে অপূরণীয় ক্ষতি। অনেক আয়োজন করে গত মাসে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার রাজনীতির কারণে দেশের ঐক্যে ফাটল, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ও নানামুখী মতবাদের মেরুকরণ। এই সবকিছুকে ঊর্ধ্বে ঠেলে আমরা কি পারব অনেক বড় আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে? কারণ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ যেটা ছিল কাগজে-কলমে বা বক্তৃতা-বিবৃতিতে তা আক্ষরিক অর্থেই শুরু হলো গত ২ জুলাই-এর মধ্যরাত থেকে। নিঃসন্দেহে এখন দৃশ্যপট অনেক বদলে যাবে। বৈদেশিক রাজনীতি, কূটনীতি, বাণিজ্য, ক্ষমতায়ন সবকিছুতেই এখন প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলবে জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা। এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে এই মুহূর্তে আমাদের জাতিগত ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন