সম অধিকার আদৌ কখনও প্রতিষ্ঠা হবে?
নভেরা হোসেন
নারীদের মধ্যে প্রায় সত্তর-আশি ভাগ নারী দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে এবং মানবেতর জীবনযাপন করে। এদের বেশিরভাগই গ্রামীন কৃষিজীবী নারী অথবা শ্রমজীবী আর বাকিরা শহরের শিক্ষিত, চাকরিজীবী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী-পুরুষের সম অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা থাকলেও সর্বত্রই নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজমান। সমাজের উচ্চবিত্ত নারী এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বাঙালি নারী ঘর থেকে বাইরের জগতে প্রবেশ করলেও তাকে সব সময় নিজের মর্যাদা এবং সম্ভ্রমকে রক্ষা করতে সারাক্ষণ অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ সে জানে একজন পুলিশ অফিসার হয়েও কর্তব্যপালনরত অবস্থায় তার ধর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে আবার পারিবারিক জীবনে বিরাজমান বাঙালি লিঙ্গীয় মতাদর্শের কারণে সেখানেও নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বিষয়গুলো ঘটে যখন সমাজ পূর্ণ বিকশিত না হয় বা অবিকশিত থেকে যায়। সমাজে পুরুষের অধিকার বলে কোনো ইস্যু নেই কিন্তু নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার এসব বিষয় সমাজে আলোচিত এর অর্থই হচ্ছে সমাজে নারী, শিশু, শ্রমিক এদের অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্যের বিষয়টি জড়িত। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, সমাজে ব্যক্তি মালিকানা সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং এর সঙ্গে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সামাজিক ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ। কমবেশি সব সংস্কৃতিতেই এই ধরনের উদাহরণ দেখা যায়, তবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোতে ব্যবস্থা কিছুটা ভিন্ন। ব্যক্তি মালিকানার এই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির নারীরা রয়েছেন যেমনÑ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত। নারী এক্ষেত্রে দুধরনের বৈষম্যের শিকার হন। এক নারী হিসেবে, দুই শ্রেণিগত কারণে। আবার একেক শ্রেণির ভিতরে নানাধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ, বিধিনিষেধের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিশেষত নিম্নবিত্তের পেশায় অংশগ্রহণের হার ব্যাপক। এদের মধ্যে কেউ উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত যেমনÑ গার্মেন্টস, কল-কারখানার কাজে যুক্ত আবার অনেকে সরাসরি উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত নন যেমনÑ ইটভাঙা, হোটেলে কাজ করা, রাস্তা ঝাড়– দেয়, গৃহশ্রমিকের কাজ করা, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করা। গার্মেন্টস বা বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তারা কিছুটা স্বীকৃত বেতনভাতা ভোগ করে থাকেন, চিকিৎসার জন্য টাকা পেয়ে থাকেন, সাপ্তাহিক ছুটি, বিনোদনভাতাসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে এক্ষেত্রেও নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিকের মজুরিতে বৈষম্য দেখা যায়। যদিও সরকারকর্তৃক ব্যবসায়ী সংগঠনের চুক্তির ভিত্তিতে গার্মেন্টসসহ সকল শ্রমভিত্তিক কাজের ঘণ্টা হিসেবে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আইএলও এর আইন অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরি এবং নিরাপত্তাজনিত সকল সুবিধা কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য কিন্তু বাস্তবে তেমনটা কম দেখা যায়। গার্মেন্টসে কম মজুরি দিতে দেখা যায়, ওভারটাইম করানো হয়, ছুটির দিনে কাজ করানো হয়। শ্রমিকেরা অনেক ক্ষেত্রে কাজ হারানোর ভয়ে মালিকের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে সাহস পায় না, নিজেদের অসুবিধার কথা বলতে পারে না, যদিও ট্রেড ইউনিয়ন আছে কিন্তু সেখানে নানা রাজনীতির কারণে সাধারণ শ্রমিকের দাবি উপেক্ষিত হয়। আর এখানেও নারী শ্রমিকেরা অধিক বৈষম্যের শিকার হন। এই নারী শ্রমিকেরা অধিকাংশই বস্তিতে বসবাস করেন যেখানে তাদেরকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। ঢাকা শহরে সরকারের খাস জমি বা দখলীকৃত জমিতে ঘিঞ্জিভাবে বস্তি বানানো হয় যেখানে নারী শ্রমিকের নিরাপত্তাও ব্যহত হয়। আবার যারা পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন সেখানে চলে পারিবারিক লিঙ্গীয় মতাদর্শগত বৈষম্য। নারীর উপার্জিত অর্থ স্বামী, বাবা-মা বা ভাইয়েরা নিয়ে নেয়। তবে সব ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে তা নয়।
উচ্চ শিক্ষিত নারীরা শ্রমিক শ্রেণির নারীদের চেয়ে পেশাগতভাবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। তবে সরকারি এবং বেসরকারি চাকরিতেও লিঙ্গীয় বৈষম্য রয়েছে। যেটা সবসময় চোখে দেখা যায় না কিন্তু প্রমোশন বা বেতনের ক্ষেত্রে, মাতৃত্বজনিত ছুটি বা কাজ বন্টনের ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠান নারীর আইনগত অধিকার সংরক্ষণ করে না। দেশে এখন যথেষ্ট পরিমাণে নারী নানা পেশায় যুক্ত হতে পেরেছে এটা অবশ্যই একটা ধনাত্বক বৈশিষ্ট্য তবে পুঁজিবাদী মূল্যবোধে নারীকে মিডিয়া অনেকক্ষেত্রেই সস্তা পণ্য হিসেবে প্রদর্শণ করে থাকে, এতে করে সে নিজের ব্যক্তিত্বকে অক্ষুণœ রাখতে ব্যর্থ হয়। কারণ পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নারীকে সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে হয়। একটা স্বাধীন দেশের, স্বাধীন নারী হিসাবে মর্যাদার সঙ্গে, নিজের মতামত অনুযায়ী পেশা গ্রহণ করতে পারা এবং নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারা এখনকার সমাজের প্রত্যাশা। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সকলক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এদেশে।
লেখক : কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন