পূর্বসূরি উত্তরসূরি
আরিফ জেবতিক
রোহিঙ্গাদের একটা ছবি আমার মনে গেঁথে আছে। পেছনে উত্তাল সমুদ্রকে রেখে একদল সব হারানো মানুষ আমাদের তীরে এসে আশ্রয় নিতে চাইছে, তাদের একজন হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে একটু আশ্রয়ের জন্যÑ আমরা তাদেরকে রাখতে পারছি না নানাবিধ কারণে।
রোহিঙ্গা নামের এই লোকগুলোর পূর্বপুরুষরা শতবছর আগে চট্টগ্রামের কূল ছেড়ে বার্মার আরেকটু ভিতরে চলে গিয়েছিলেন। শতবছর পরেও মায়ানমার তাদেরকে গ্রহণ করেনি, অন্যদিকে আমরা শতবর্ষের বহমান স্রোতধারায় নিজেদের রাষ্ট্র তৈরি করেছি, সেই রাষ্ট্রের ইতিহাসে কি বর্তমানে রোহিঙ্গাদের কোনো ঠাঁই নেই? তারা আমাদের লোক নন, নৃতত্ত্বে তাদের সঙ্গে আমাদের দৈহিক মিল আছে, কিন্তু শতবর্ষ ধরেই তারা আমাদের সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে গেছেন।
ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের অবস্থা ফেসবুকে স্ক্রল করে দেখছিলাম। অনেক ভিডিওতে ফেসবুক সয়লাব। বাস থেকে নামিয়ে দিতে চাচ্ছে এক ইমিগ্রান্টকে, মসজিদের সামনে গিয়ে গান গাচ্ছে কোথাও, কোথাও জেব্রাক্রসিংয়ে পাকিস্তানি মহিলার গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি তুলে দিতে চাচ্ছে কেউ, পোলিশ দোকান লুটপাট হয়েছে, মোটের ওপর সাম্প্রদায়িকতা সেখানে আছড়ে পড়ছে। হয়তো এখনও একে দুর্যোগ বলা যাবে না, সবগুলোই হয়তো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ কিন্তু সেগুলো বড্ড চোখে লাগছে। জন্মসূত্রে সিলেটি মানুষ। আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, একমাত্র ছোট ভাইটা অথবা আত্মীয় হিসেবে তৈরি হয়ে যাওয়া ছোট ভাই বড় ভাইদের বন্ধুরা, সব মিলিয়ে ব্রিটেনে আমার শতশত আত্মীয়।
মাঝে মাঝে যখন ক্লান্ত হয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবি, তখন ব্রিটেনের কথাই প্রথম মনে হয়। এক জনমে মানুষ আর নিজের ভূমে ফিরতে পারে না। আমি যদি যাই, মেয়েগুলো ব্রিটেনেই বড় হবে, পরের প্রজন্মে হয়তো নাতিপুতিরা বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনোই ফিরবে না।
এরকম পরিজন আমাদের সকলেরই বিশ্বজুড়ে। কেউ ইউকে তো কেউ আমেরিকা তো কেউ কানাডা কি সুইডেন। বিশ্বের কোথাও স্থায়ীভাবে শুভ মানুষের জয় এখনও অর্জিত হয়নি। হিংসা আছে, ঘৃণা আছে, সভ্যতা আর শুভ্রতার দোহাই দিয়ে সেগুলো কার্পেটের নিচে চাপা দিলেও সেগুলো যে আছে সেটি এরকম ব্রেক্সিট জাতীয় ঘটনায় হুট করে বেশিবেশি করে বেরিয়ে পড়ে।
ব্রিটেনের আজকের খবরগুলো দেখতে দেখতে পড়তে পড়তে তাই আমার শুধু সেই রোহিঙ্গা দলটির কথা মনে পড়ে যায়। এত সাধের বাংলাদেশে, এত প্রেমের বাংলাদেশে আজ থেকে শতবছর পরে আমার কোনো উত্তরপুরুষ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, বাংলাদেশ বাস্তব কারণেই তাকে আর আশ্রয় দিতে পারবে না। এই সম্ভাবনা আর আশঙ্কার কথা মনে পড়তেই এই শেষ রাতে মনটা বিষণœ হয়ে যায়।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন