গঞ্জিকা ও লালন
পিনাকী ভট্টাচার্য
লালনের আখড়ায় গিয়ে গঞ্জিকা সেবনের একটা ব্যাখ্যাও আজকে ফেইসবুকে এসেছে। ব্যাখ্যার মর্মার্থ হচ্ছেÑ লালন বাউল ছিলেন এবং এই বাউলেরা দেহতত্ত্ব চর্চা করে, এই দেহতত্ত্ব চর্চার জন্যই তরুণেরা বাউলসঙ্গ করতে গিয়েছিলেন লালনের আখড়ায়। একদিনের জন্য এই বাউলসঙ্গে গঞ্জিকা সেবনে কোনো অপরাধ হয় না।
আমি বলি, একদিনের জন্য কেন, চিরজীবনের জন্য গঞ্জিকা সেবনেও কোনো অসুবিধা নেই। নদিয়ার ফকির বলতেন ‘তুমি গাঁজা খেতে পার, কারণ স্বয়ং দেবের দেব মহাদেব গাঁজা খেতেন। কিন্তু তিনি আগে সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য বিষ খেয়ে সেই বিষ কণ্ঠে ধারণ করে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়েছেন। তিনি মহাদেব। কিন্তু তুমি গাঁজা খেয়ে সমাজের এমন কি উপকার করছ যাতে জীবের বা ব্রহ্মা-ের এক রতি উপকার হয়?’
দ্বিতীয় মুশকিলটা হচ্ছে, লালন তো বাউল ছিলেন না। নিজেকে কস্মিনকালেও তিনি নিজেকে বাউল বলেননি। লালন নিজেকে ফকির বলতেন। লালনকে ‘বাউল’ বললে নেশা, যৌনতাসহ মধ্যবিত্তের বিকৃতরুচির শহুরে ফ্যান্টাসি তার নামে ন্যায্য প্রমাণ করা যায়।
‘তিন পাগলের মেলা’ বলে যেই গানটি গাওয়া হচ্ছিলÑ ব্যাকগ্রাউন্ডে তারা নদিয়ার ভাবের তিনগুরু চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য। এই তিনগুরুই গানের ‘তিন পাগল’। সেই নদিয়ার ভাবের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে বাংলায় লালন, সতী মা, পাঞ্জু শাহ, চৌধুরী ও দেলবার শাহ এই পাঁচ ঘরে। লালন এই ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল আইকন।
নদিয়া দেহবাদী কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এই দেহবাদ প্রাচীনতন্ত্র ও নানাবিধ গুহ্যসাধনা থেকে আলাদা। প্রাচীন দেহতত্ত্বের সঙ্গে তার অনেক আগেই ছেদ ঘটেছে। নদীয়ার দেহ শুধু মানুষের দেহ নয়, এই দেহ একই সঙ্গে প্রকৃতি বা ব্রহ্মা-। সেই দেহ শুধু ভোগের উপায় নয়। তাই দেহ নিয়ে নদীয়ার অনুমান, সিদ্ধান্ত ও করণকর্ম আলাদা।
সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণি ফকিরদের রাজনৈতিক লড়াই, সংগ্রাম ও ভাবচর্চাকে হেয় প্রতিপন্ন করবার জন্য ভাবচর্চাকে স্রেফ নেশাদ্রব্য গ্রহণ ও গুহ্যচর্চা হিসেবে প্রচার করে আসছে।
যেই লালন বাংলাদেশের নিম্নবর্গের চলমান লড়াইয়ের আইকন হয়ে উঠতে পারে, পথ দেখাতে পারে, সেই বৃহত্তর সমাজ থেকে লালনকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টাই এই মধ্যবিত্তের ‘গঞ্জিকা অভিযান’। কারণ ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির রাজনীতির জন্য নিম্নবর্গের মানুষের ভাবান্দোলন বিপজ্জনক।
লালনসহ সাধকেরা সবাই এই সমাজেই বাস করে নিজেদের বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে বরং বিপ্লবীদের মতই নিজের জীবন দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে সমাজকে অনুপ্রাণিত করেন।
মধ্যবিত্ত বিপ্লবের ঠিকা নিলে কী অবস্থা হয়, বাংলাদেশের বাম আন্দোলন তার জলন্ত প্রমাণ। বাংলার ফকিরদের ভাবচর্চার ঠিকা মধ্যবিত্তকে দেওয়া হবে না। তাই লালনের আখড়ায় মধ্যবিত্তের গঞ্জিকা অভিযানের বিরুদ্ধে আমাদের এই লড়াই জারি থাকবে।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন