জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে ক্রসফায়ার কি অনিবার্য?
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিবাদের উত্থানের সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততা আছে। যদিও এটাকে এই মুহূর্তে ‘সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ’ বা ইনসার্জেন্সি বলা যায় না, তথাপি এর মধ্যে ইনসার্জেন্সি এবং বর্তমান সরকারের পতনের একটা সশস্ত্র চেষ্টার কিছু উপাদান রয়েছে। জঙ্গিবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের কোন রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে চায়। বর্তমানে জঙ্গিদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের ধরন দেখে বোঝা যায়, এটি একটি সুপরিকল্পিত সন্ত্রাস যার পেছনে অনেকে জড়িত।অতীতের নানান সরকারবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন যেমন পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন, ভারত ও নেপালের মাওবাদী আন্দোলন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এসব আন্দোলনকারীরা নানারকম সামাজিক অসঙ্গতিকে সবার সামনে তুলে ধরে এবং শুরুতে সেইসব ব্যক্তিকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করে, যাদের হত্যা করলেও জনমত তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিপক্ষে না চলে যায়। যে কারণে প্রথম দিকে জঙ্গিরা কতিপয় ব্লগারকে ‘নাস্তিক’ ট্যাগ লাগিয়ে হত্যা করে। এইসব হত্যাকা-ের বিপক্ষে সচেতন মহল সোচ্চার হলেও সাধারণ মানুষের বড় একটা অংশের মধ্যে এটা তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। তারা বরং ‘নাস্তিকরা ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার খেসারত দিচ্ছে’ এ ধরনের মানসিকতা নিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে। তখন আমি এই পত্রিকাতেই ‘নাস্তিক মরছে, আস্তিক বাঁচবে তো?’ শিরোনামে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম। আজ তার সত্যতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। জঙ্গিদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের টার্গেট আজ আর কেবল নাস্তিক ব্লগাররাই নন বরং পাদ্রি-পুরোহিত-বাউল প্রেমী চিকিৎসক থেকে শুরু করে নিরীহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কেউই আর নিরাপদ নন।
এমতাবস্থায় সরকারবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালাতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর দায়িত্ব আওয়ামী লীগসহ সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দলসমূহের। প্রয়োজনে পাড়ায়-মহল্লায় সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করতে হবে। যে রাজনীতি জঙ্গি-সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তার মুখোশ জনগণের সামনে উন্মোচন করে রাজনৈতিকভাবে তাদের দুর্বল করতে হবে। দেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান উন্নতির পাশাপাশি জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের পথগুলো বন্ধ করতে হবে। এইসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনীরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মানবাধিকারের সঙ্গে সংঘাত থাকা সত্ত্বেও সশস্ত্র জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে বন্দুকযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী একটা স্বীকৃত পন্থা। এই বন্দুকযুদ্ধ ইতোপূর্বে সাধারণ সন্ত্রাসী দমনে প্রচলিত বন্দুকযুদ্ধের চেয়ে ভিন্ন। এর মধ্য দিয়ে অন্যান্য জঙ্গিদের একটি সতর্কতামূলক বার্তা দেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যতে এই প্রাণঘাতী পথে পা বাড়ানোর আগে তারা যেন পরিণতির ব্যাপারটাও ভাবে। তবে প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের আগে নিরাপত্তাবাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে, কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কোনো দেশেই জঙ্গি তৎপরতা দীর্ঘমেয়াদী হতে দেওয়া ঠিক নয়। তবে কেবলমাত্র নিরাপত্তাবাহিনী আর বন্দুকযুদ্ধের ওপর নির্ভর করে জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনের চেষ্টা করা হয়, তবে তা ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাই বেশি।
জঙ্গিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযানে জনগণের সমর্থন তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ক্ষেত্রে জনগণ অনেক সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং শুরুর দিকে কোনো পক্ষেই যায় না। সুতরাং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। বন্দুকযুদ্ধে কতিপয় জঙ্গি হত্যাই জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সাফল্য নয়। বরং এইসব জঙ্গি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে পরাজিত ও জনবিচ্ছিন্ন করার মধ্যেই এই অভিযানের চূড়ান্ত সাফল্য নিহিত আছে। জনগণই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের প্রত্যাখ্যান করবে।
লেখক : কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন