জলের জন্য খুনোখুনি হচ্ছে ভারতে
পরাগ মাঝি : ভারতের এমন কিছু শুষ্ক অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে যেখানে জলের জন্য মানুষের মাঝে হিংস্রতা বাড়ছে এমনকি তারা খুনিও হয়ে উঠছে। উত্তর এবং মধ্য ভারতের বুন্দেলখান্দসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের পুলিশের বরাত দিয়ে জানা গেছে- তীব্র গরম এবং খরায় এসব এলাকায় অপরাধ বেড়ে গেছে। কেবল পানির জন্যই সেখানে অহরহ খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে।
টানা ১০ বছরের কম বৃষ্টিপাত এবং কয়েকটি তীব্র খরার বছর এসব এলাকার নদী, লেক, জলাধার এবং কূপগুলোকে পুরোপুরি শুকিয়ে দিয়েছে।
ভারত এমনিতেই একটি বিরোধপূর্ন দেশ; এর বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মানুষের ঝগড়া বিবাদ নিত্যদিনকার ঘটনা। দেশটির পুলিশের বক্তব্য, বর্তমান খরা পরিস্থিতিতে এসব বিবাদ ক্রমেই চূড়ান্ত হিং¯্রতা এবং রক্তাক্ত পরিস্থিতির দিকে মোড় নিচ্ছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে নিজের জিম্মায় রাখা শেষ পানিটুকু বাঁচাতে কেউ কেউ বন্ধু, প্রতিবেশী এমনকি পরিবারের মুখোমুখিও হচ্ছে।
এই যেমন, ইমারাত নামদেব (৪৮) এবং তার ছোটবোন পুষ্প নামদেব (৪২)। বুন্দেলখান্দের চাতারপুর জেলায় তারা প্রতিবেশী ছিলেন। একটি কূয়া থেকেই তারা পানি সংগ্রহ করতেন। খরা শুরু হলে পানির ব্যবহার নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ চলছিলো নিয়মিতই। কিন্তু পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী, গতমাসে পানি নিয়ে তাদের ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে- পুষ্প তার বোনকে বেদম প্রহার করে। আহত বোনকে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু সে সেখানেই মারা যায়। পুষ্প তাই খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত।
ইমারাতের ছেলে জিতেন্দ্র রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলে, আমাদের গ্রামে পানির খুব অভাব। পুষ্প সব সময়ই ভাবতো, আমার মা কূপ থেকে বেশি পানি নিয়ে যাচ্ছে।
গত মাসেই দেশটির মধ্যপ্রদেশের উপজাতি অধ্যুষিত আলিরাজপুর জেলায় ১৩ বছরের সুরমাদা ঘরে মেহমান এসেছে তাই তার ভাই এবং কাকাকে নিয়ে প্রতিবেশীর চাপকলে পানি তুলছিলো কোন অনুমতি ছাড়াই। এসময়, চাপ কলের মালিক ও তার ছেলে তাদের আক্রমণ করে। তীরের একটি ফলা সুরমাদার চোখ বিদ্ধ করে ভেতরে ঢুকে যায়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সুরমাদা। আর শিবপুর জেলার কানকার গ্রামে দুই মটরসাইকেল চালক বিবাদে জড়ায়। তাদের একজনের কাছে প্রায় ১৫ লিটার পানির একটি জার ছিলো। এই জারটিই বিবাদের কারণ। দুজনই তাদের পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবকে খবর দিয়ে জড়ো করে ঘটনাস্থলে। দুপক্ষ এসময় বর্শা, কুড়াল এবং লাঠি নিয়ে একে অপরকে আঘাত করে। এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা জয়সিং যাদব জানান, ওই মারামারির ঘটনায় ১৫ জন মারাত্মক আহত হয়েছিলো, যার মধ্যে অন্তত পাঁচজন নারী ছিলো। মধ্যপ্রদেশের নগর প্রশাসন এবং উন্নয়নমন্ত্রী লাল সিং আরিয়া বলেন, প্রত্যেকের জন্য পানি নিশ্চিত করতে সরকার তার সব উৎসকে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু বর্ষা এলেও এখনো বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, পরপর দুটি খরার কারণে এই প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় জলের জন্য তীব্র বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষার বৃষ্টি ঝরলেই এর সমাধান মিলবে। তবে সমালোচকরা খরায় আক্রান্ত এলাকাগুলোতে পানির ব্যবস্থা করতে সরকারের ব্যর্থতাকেই পুরোপুরি দায়ী করছেন। অতিরিক্ত ব্যায়, পানি নষ্ট করা এবং স্বল্প পানির অনিয়মতান্ত্রিক বিলি ব্যাবস্থার জন্যই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মধ্যপ্রদেশ কেন্দ্রিক একটি বেসরকারী পরিবেশরক্ষা সংগঠনের কর্মী অজয় দুবে। তিনি বলেন, পানির খোঁজে মানুষ হেন কোন দূর নেই যে যাচ্ছে না, পরিস্থিতির যে উত্তরণ ঘটবে এই আশা করাটাই তারা ছেড়ে দিয়েছে, এমন দু:সহ সময় এখানে আর কখনো ছিলোনা।
মধ্যপ্রদেশের পানি সম্পদ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, রাজ্যের ১৩৯ টি জলাধারের ৮২ টি থেকে মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে এবং ২২ টি একেবারেই খালি। কর্তৃপক্ষ চাইছে বৃষ্টি আসার আগ পর্যন্ত যতটুকু পানি আছে ততটুকু দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়া। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ এলাকায়ই ট্রাক এবং গাড়ি ধোয়ার উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, এমন কি কৃষিসেচ ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়েছে। মধ্য প্রদেশের বেশিরভাগ শহরেই স্থানীয় প্রশাসন প্রতি সপ্তাহে মাত্র দু’দিন পানি সরবরাহ করে।
রাজ্যটির শেহর শহরে পানির উৎস সরকার কিংবা ব্যাক্তিগত যাই হোক না কেন এর জন্য উচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। আর রাজ্যটির অন্তত তিনটি শহরে পানি পান ছাড়া অন্য কোন ব্যাবহার একেবারেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইশাওয়ার শহরের সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট লোকেশ কুমার জানান, ওই এলাকায় জুলাইয়ের ৫ তারিখ পর্যন্ত সেচ এবং শিল্প যা-ই হোক না কেন তা বন্ধ রাখতে হবে। কর্তৃপক্ষ আশা করছেন এ সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি আসবে এবং পানি উৎসগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।ভারতের গ্রামীন এলাকাগুলোতে স্বল্প পানি নিয়ে টিকে থাকাই মানুষের জন্য কঠিন কাজ হয়ে পড়েছে। বুন্দেলখান্দের মতো এলাকাগুলো থেকে প্রতিনিয়তই লোকজন রাজ্য ছেড়ে পালাচ্ছে, পাড়ি দিচ্ছে বহুদূরের পথ কেবলমাত্র একটুকু পানি পানের জন্য। আসাদি দাস চাতারপুর জেলার এক গ্রামে বসবাস করেন। তিনি তার পরিবার নিয়ে উত্তর প্রদেশের আগ্রায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি জানান, তার পরিবারে এই মহুর্তে কোন খাবার এবং পানি অবশিষ্ট নেই। তিনি জানেন আগ্রায় গিয়েই জীবন সহজ হয়ে যাবেনা। তবে সেখানে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে চান।
দাস বলেন, আমরা আর আমাদের গ্রামে টিকে থাকতে পারছিনা। সেখানে বিন্দুমাত্র পানি নেই। যদি বাঁচতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। ডেইলি মেইল অবলম্বনে