অংশ নেয় সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার সহস্রাধিক সদস্য ১৩ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর থান্ডার বোল্ট অপারেশন
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : গুলশানে জঙ্গি দমন ও জিম্মিদের উদ্ধারে পরিচালনা করা হয় থান্ডার বোল্ট অপারেশন। অভিযানে অংশ নেয় সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার সহস্রাধিক সদস্য। তারা ঘটনাস্থলের পুরো এলাকা ও এর আশপাশের সব জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। অভিযানের এলাকার বাইরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য অংশ নেয়। অভিযান পরিচালনাকারীরা প্রথমে রেস্টুরেন্টের বাইরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ভেতরে অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সকল স্থানে অবস্থান নিশ্চিত করার পর ও জঙ্গিরা যাতে কোনোভাবেই পালিয়ে যেতে না পারে ও অন্য কোনো জঙ্গি গ্রুপ আক্রমণ চালাতে না পারে সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। সব দিক বিবেচনা করে ঠিক সাতটা চল্লিশ মিনিটে অভিযান শুরু করা হয়।
থান্ডার বোল্ট অভিযানের তত্ত্বাবধান করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ সফিউল হক। আরও ছিলেন নৌবাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক ও অন্যান্য সংস্থার প্রধানগণ।
থান্ডার বোল্ট অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচালক অপারেশন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী, সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মজিবুর রহমান, সেনাবাহিনী প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. এম এম ইমরুল হাসান। প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যদের অভিযান পরিচালনার জন্য সিলেট থেকে ঢাকায় আনা হয়। সিলেটের প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়নের টিম এই ধরনের অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে পারদর্শী।
১২-১৩ মিনিটের এই অভিযান পরিচালিত হয়
অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হয় সেনাবাহিনী সব বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের তরফ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
সূত্র জানায়, এই ধরনের কমান্ডো অপারেশন পাঁচ মিনিটেই করা সম্ভব। এই ধরনের অভিযান সাধারণত এমনই হয়। এখানে যারা বিপক্ষ থাকে তাদের এক মিনিটও সময় দেওয়া যায় না।
প্রধানমন্ত্রী যখন অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দেন তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কমান্ডো অভিযানের পরিচালনা করে।
সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২-৩ হাজার সদস্য পুরো এলাকা ঘিরে রাখে। নৌবাহিনীর সদস্যরা লেকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেখান দিয়ে কেউ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
সামরিক বাহিনীর দশটির মতো সাঁজোয়া যান পৌঁছানোর পর সেখানে তারা গেট ভেঙে প্রবেশ করে। সামরিক বাহিনীর সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখে জঙ্গিরা গুলি ছুড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। পুরো ১২-১৩ মিনেটের মধ্যে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচালক (অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, শুক্রবার রাত প্রায় পৌনে নয়টায় রাজধানীর গুলশান-২ এর রোড নং ৭৯-এর হলি আর্টিজান বেকারি নামক একটি রেস্টুরেন্টে দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রবেশ করে এবং রেস্টুরেন্টের সকলকে জিম্মি করে। ঘটনা ঘটার সাথে সাথে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে অভিযান পরিচালনার জন্য মাননীয় সরকার প্রধান কর্তৃক আদেশ প্রদান করা হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অপারেশন থান্ডার বোল্ট পরিকল্পনা করে।
তিনি বলেন, আমরা শুক্রবার রাতেই ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করি। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব সহযোগে সম্মিলিতভাবে অপারেশন থান্ডার বোল্ট পরিচালনা করা হয়। আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে ৭টা ৪০ মিনিটে অপারেশন শুরু হয়। ১২-১৩ মিনিটের মধ্যে সকল সন্ত্রাসীকে নির্মূল করা হয়। এরপর টার্গেট এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অপারেশনের পর অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করারও প্রয়োজন ছিল। সেই হিসাবে সকাল সাড়ে আটটায় অভিযানের সফল সমাপ্তি হয়।
অভিযানে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের কেউ যাতে বের হতে না পারে ও নিজেরা মারা যায়। এই কারণে তাদের আটক করার জন্য আলাদা আলাদা টিম গঠন করা হয়। একটি টিম গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। একটি টিম জঙ্গিদের ধরে ফেলার সব ব্যবস্থা করে। একটি টিম জীবিতদের উদ্ধার করে। আরও টিম ছিল যারা সার্চ করে। তারা মৃত দেহ আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করে। আটক রেস্টুরেন্টের ভেতরের কেউ যেন বাইরে বের হতে না পারে সেই জন্য সবাইকে নজরদারিতে রাখা হয়। অভিযানের শেষে তল্লাশি করে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
উদ্ধার করা হয় হত্যাকা-ের ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রও। হত্যাকা-ের ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ছাড়াও অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে ৪টি পিস্তল, ১টি ফোল্ডেড বাট একে ২২, ৪টি অবিস্ফোরিত আইইড, ১টি ওয়াকি টকি সেট ও ধারালো দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি