রক্তপাতের বিপরীতে আসুন নয়ন জলে ভাসি
অজয় দাশগুপ্ত
শুরুতেই বলব গুলশান ট্র্যাজেডি নিয়ে গুজব বা মনগড়া কাহিনী বানাবেন না। সামাজিক মিডিয়ার বড় বিপদ তার ইচ্ছেমতো বলা বা লেখার অবাধ স্বাধীনতা। অন্তত এমন জটিল বিষয়ে আমরা যেন তার শিকার না হই। একবার ভেবে দেখুন কি নির্মম, নৃশংস এই হত্যাকা-। মারার আগে ধর্মের নামে যে মাতম বা তার অপব্যবহার তাকে কেন ধর্মের দোষ মনে করছি আমরা? এত বিকৃত মস্তিষ্ক, বিকৃত মনের কিছু অপরাধীর তা-ব। যারা দুনিয়াজুড়ে হত্যার খেলায় মারবার নেশায় মেতে উঠেছে। এরা যাদের মেরেছে তাদের ভিতর মুসলিম ছিল না? ছিল। ছাড় পায়নি। কারণ এদের মনমতো বিশ্বাসের জবাব দিতে পারেনি বলে। এরা কারা?
সাধারণভাবে কিছু হলেই আমরা মাদ্রাসার দিকে আঙুল তুলি। সংসারে, পরিবারে সবচেয়ে কম মেধাবী বা গরিব ছেলেটিকে পাঠানো হয় সেখানে। কোনো বিত্তবানের ছেলে যায় মাদ্রাসায়? এই দরিদ্র শিশু, কিশোর বা যুবকদের নিয়ে রাজনীতি খেলাধুলা না করলে তারা সেই চারদেয়ালের বাইরে পা বাড়ায় না। যখন শাপলার ঘটনা হলো কি দেখলাম আমরা? বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর তাদের ছোটাছুটি আর ভয়ার্ত পলায়ন। এমনও দেখা গেছে, পুলিশকেই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। সেসব কিশোর বা যুবকরা রাজনীতির শিকার বটে কিন্তু জঙ্গি ছিল না। তারা কোনো অস্ত্র বয়ে আনেনি। তাদের হাতে ছিল না অটোমেটিক রাইফেল বা বোমা। আজ আমরা কি দেখছি? জীবনভোগী বিত্তবান ধনীদের ছেলেরা এসেছিল মানুষ মারতে। যারা এ যাবৎ শনাক্ত হয়েছে তাদের বয়স ও পরিবার বিবেচনায় তারা এমন হিংস্র ও মৌলবাদী হবার কথা? কিন্তু তারাই করেছে এই বর্বরোচিত কাজ।
খোলা দুনিয়ার বিশাল জগৎ যখন তাদের উদার দিগন্তে নেওয়ার কথা তখন তারা প্রেম ভালোবাসা ও জীবনের চাইতে এমন এক বিষয়কে মূখ্য মনে করেছে যার পরিণতি মৃত্যু। এ কেমন চিন্তা? একবার ভেবে দেখুন এরা নিজেদের জীবনকে কতটা তুচ্ছ মনে করেছে। জীবনবোধের এমন অভাব আর পরিবর্তিত মানসিকতা কি পরিবারের চোখে একবারও ধরা পড়েনি? খবরে দেখলাম, এদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি বেশ কিছুদিন নিখোঁজ ছিল? কেমন করে হয় তা? অভিভাবকেরা কোথায় ছিলেন? আমাদের সময় তো এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় গিয়ে না ফিরলে বিকেল থেকে মাইকিং করে খোঁজা হতো। আমার নিজের বেলায় বিয়ের পরও দেরি করে বাড়ি ফিরলে মা দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির পাশের লাইটপোস্টের তলায়। তবে কি মা বাবাদের সময় নেই আর? কম্পিউটার, ফেসবুক, মোবাইল পার্টি রোজগারের আকর্ষণে তারা সন্তানের খবরও রাখেন না? ছেলে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে কি তার চাওয়া, মা জানবে না? বাবা খবর রাখবে না? নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে ব্যবস্থা নেবে না? বড়লোক বা উচ্চবিত্তদের ঘরে এখন সাপ কিলবিল করছে। তাদের জীবন ও জীবনবোধের ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে কঠিন মৌলবাদ। লেখাপড়ার নামে সার্টিফিকেট আর প্রাইভেটের চাপে দিশেহারা তারুণ্য কোথায় মুক্তি চাইছে, কি তার কামনা, কি তার অপরাধবোধ ও দায়Ñ এর জবাব খুঁজতে হবে এখন। তা না হলে এমন ট্র্যাজেডির হাত থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না। কারণ এরা ইচ্ছাকৃত মগজ ধোলাইয়ের শিকার। অর্থবিত্ত, নারী বা অন্য লোভে নয় এদের বিকৃতির কারণ আরও গভীর কোনো হতাশার।
ভাবতেই পারছি না সেসব মানুষের কথা যারা একটু আগেও জানত না কি নির্মম মৃত্যু ওৎ পেতে আছে। অপরাধহীন মানুষের গলাকেটে হত্যা যারা দেখল, তারা জানে বেঁচে আছে বটে আসলে কি তারা আর কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবে? একবার নিজেকে দিয়ে ভাবুন। আপনি দেখবেন আপনার সামনে গলাকেটে ছেড়ে দেওয়া মানবসন্তান ছটফট করে মারা যাচ্ছে। এই বিভীষিকার নাম ধর্মযুদ্ধ?
বাংলাদেশ এমনটি কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। মায়ার দেশ অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ নামে পরিচিত আমাদের আকাশে আজ আবির নয় রক্তের মেঘ। আমাদের সবুজ মাটিতে আজ ছোপ ছোপ লাল দাগ। আমাদের উঠানে রক্তমাখা পায়ের চিহ্ন। আমাদের সবার হাতেই কি দু-এক ফোঁটা রক্ত এসে দাগ দিয়ে যায়নি? আহারে সেই মধ্যবয়সী মায়াবী রমনীর মুখ। আহা সেই যুবকের স্বপ্নমাখা অবয়ব। মৃত বিদেশিরা একবার কি আর্তচিৎকারে নিজেদের ভাষায় ঈশ্বরকে ডেকেছিলেন তাদের বাঁচাতে? ঈশ্বর নিজেই হয়তো অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন উন্মাদ হত্যাকারীর দিকে। ভাবছিলেন এই আমার অমৃতের সন্তান? এই সৃষ্টির সেরা জীব?
বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে মলিন বেদনার্ত মাথানিচু করার সংবাদ শিরোনাম। দেখে আমরাও লজ্জায় মরে যাই। মনে মনে কাঁদি আর বলিÑ তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। আসুন গলা জড়িয়ে কাঁদি আমরা। কান্নায় ধুয়ে ফেলি রক্তের দাগ।
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন