প্রতারণা, হয়রানি আর চাঁদাবাজি ঈদের বাস্তবতা
মিল্টন বিশ্বাস
বর্তমান সরকারের শত প্রচেষ্টা এবং আন্তরিকতা সত্ত্বেও ঈদের বাস্তবতা হচ্ছেÑ ‘অজ্ঞান পার্টি, থুতু পার্টি, ধাক্কা পার্টির সীমাহীন দৌরাত্ম্য, সক্রিয় পকেটমার, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ জুন) ঈদ আনন্দ উদ্যাপনের জন্য এ পরিস্থিতি মানুষ মুখ বুজে সহ্য করলেও প্রত্যেকেই ভিতরে ভিতরে প্রবলভাবে আতঙ্কিত আর ক্রমাগত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ঈদের সময় মানসিক যাতনা ও আর্থিক ক্ষতির একটি চিত্র এরকমÑ মিঠুন রেলস্টেশনে টিকেট কিনতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ৫০০ টাকার নোট বের করে বগুড়ার একটি টিকেট কিনতে চাইল। বুকিং ক্লার্ক টাকা গ্রহণ করে মিঠুনের অন্যমনস্কতার সুযোগে ৫০০ টাকার নোটটি ফেরত দিয়ে বলল, জাল টাকা, পাল্টে দিন। মিঠুন তার কাছে থাকা অন্য একটি নোট বের করে টিকেট নিয়ে বাসায় ফেরত আসে এবং দেখতে পায় ওই জাল টাকাটি পূর্ব থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া। সে স্মরণ করে দেখে তার কাছে এ ধরনের নোট ছিল না। তাহলে বুকিং ক্লার্ক তার অন্যমনস্কতার সুযোগে জাল টাকার অভিযোগ কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। সে অবাক হয় প্রতারণার এ অভিনবত্বে। অর্থাৎ আপনার আসল টাকা জাল টাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, ওইটির পরিবর্তে নকল টাকা ফেরত দিয়ে। আর তা ঘটছে আপনার অন্যমনস্কতার সুযোগে। জাল টাকার প্রতারণা যেমন তেমনি ঈদের মার্কেটে পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য হাকা এবং ‘ঈদ’ ‘ঈদ’ বলে অতিরিক্ত টাকা বাগিয়ে নেবার প্রবণতা সর্বত্রই অসহনীয় হয়রানির দৃষ্টান্ত। এর ওপর রয়েছে চৌদ্দ ঘাটের ষোল রকমের চাঁদাবাজি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, ‘পুলিশের চাঁদাবাজি’ শিরোনামের খবর। এখানে বলা হয়েছে, ‘সুযোগসন্ধানীদের সরকারি সম্পত্তি দখল করে অবৈধ দোকান নির্মাণ, কাঁচাবাজার বাসানো, ফুটপাত দখল করে হকারদের দোকানপাট বসানোÑ এসব অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। পুলিশের কাজ হচ্ছে এসব অবৈধ উদ্যোগ প্রতিহত করা। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো। অভিযোগ রয়েছে, এসব অবৈধ কাজে পুলিশের এক শ্রেণির সদস্য নিয়মিত সহযোগিতা করে। বিনিময়ে মাসোহারা বা চাঁদা আদায় করে।’ এই চাঁদার অঙ্ক মাসে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি। বেদখলকৃত জমি উদ্ধার না করে অবৈধ স্থাপনাকে স্বীকৃত দিচ্ছে পুলিশ এবং তা চাঁদার বিনিময়ে। আর চলাচলের জায়গায় দোকানপাটের কারণে সাধারণ মানুষের চলাফেরায় যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনি সেখানে চুরি, ছিনতাইয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে। রাজধানীর চিত্র এটি। ঈদের উপলক্ষ্য থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি? এ ধরনের কাজ স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য হচ্ছে দেশের সর্বত্রই। আবার পুলিশের সঙ্গে মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের সখ্য রয়েছে। ফলে তাদের হাতে রেলস্টেশন ও লঞ্চ ঘাটে প্রতিদিনই যাত্রীরা নানারকম হেনস্তার শিকার হলেও কেউ তার প্রতিকার পাচ্ছে না। অথচ সরকারের তরফ থেকে ঈদের দুর্ভোগ অবসানের জন্য নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রতিবছরই।
আসলে দেশে ঈদকে কেন্দ্র করে হয়রানি, প্রতারণা আর চাঁদাবাজির উপদ্রব সকল সীমা অতিক্রম করেছে। যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রীর শত প্রচেষ্টার পরও যেমন সকল রাস্তা এখনও ঠিক হয়নি, তেমনি ছিনতাই রাহাজানি বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়েও নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হচ্ছে না জনগণের। উপরন্তু আছে অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতা। প্রতিবছর ঈদের আগে অনেক মানুষ এসব প্রতারকের কবলে পড়েন। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা প্রস্তুতির মধ্যেও ভয়ঙ্কর প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে মানুষের সর্বস্ব। সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টিসহ সব ধরনের প্রতারকরা ১২ মাসই সক্রিয় থাকে, তবে প্রতি বছর ঈদ মৌসুম ঘিরে তাদের দৌরাত্ম্য অনেকগুণ বেড়ে যায়। গত এক সপ্তাহে কেবল রাজধানীতেই অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। তাদের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। গত বছর ঈদ উপলক্ষে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ পরিষদ। ঈদের সময় যানবাহনে স্বাভাবিক ভাড়ার দু-তিন গুণ আদায় করা হয়। ঘরমুখী মানুষকে জিম্মি করে যানবাহনের মালিকেরা এভাবে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ির ছাদেও যাত্রী পরিবহন করা হয়। ইতোমধ্যে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা হয়রানির শিকার হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। হয়রানি বন্ধে প্রত্যেকটি ঘাটসহ কাওড়াকান্দি ও মাওয়া ঘাটের দুই পাড়েই বিআইডব্লিউটির লোক নিয়োজিত থাকছে। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিবি পুলিশ, ব্যাটালিয়ন ও আনসারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যাত্রীদের বিশেষ নিরাপত্তা দিচ্ছে। নৌপথের এ বাস্তবতা খুব যে ভালো এখনও বলা যাচ্ছে না। কারণ ঈদকে সামনে রেখে অতিরিক্ত যাত্রীবহন ও বেশি ভাড়া আদায় করা তাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। সেসব দমন করতে প্রশাসন কতটুকু সক্ষম হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়।
আষাঢ় মাসে ঈদ হওয়ায় অতিরিক্ত চাপে এবার দেশের প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়কের অধিকাংশই ভরে যাবে খানাখন্দে। কয়েকটি রুটে যানবাহন চলাচলও বন্ধ হওয়ার মুখে পড়বে। বিভিন্ন রুটে গাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিবছর যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ দেখা যায়। মৃত্যুমুখে পতিত হয় কেউ কেউ। দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকা থেকে আবদুল্লাপুর ও গাবতলী হয়ে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় যাতায়াতকারী যানবাহনগুলোকে অন্তত ১০টি বিপজ্জনক যানজট পয়েন্ট পার হতে হয়। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলীয় রুটগুলোতে চলাচলকারী যানবাহনসমূহকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের অন্তত ১৪টি যানজট স্পটের আতঙ্কে থাকতে হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নিত্যদিন ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয় সাধারণ মানুষকে। যাতায়াতের দুর্ভোগে রয়েছে কালোবাজারিদের নকল টিকিটের হয়রানি। যেমন ট্রেন যাত্রায় একই টিকেট অনেককে বিক্রি করার প্রতারণা দেখা যায়। ফটোকপি করে একই টিকেট একজনের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে আবার আরেকজনকে মূল কপি বিক্রি করা হয়। ট্রেনে উঠে উভয়ে সিট দাবি করলে মূল কপিওয়ালা বসতে পারে, প্রতারণার শিকার যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ রেলস্টেশন ও লঞ্চ ঘাটে রয়েছে দুর্বৃত্তদের আনাগোনা। ছিনতাইকারী বেশে দুর্বৃত্তরা ট্রেনের মধ্যেই লুটে নেয় যাত্রীদের সর্বস্ব। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে যাত্রীদের খুন করে পথিমধ্যে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। লঞ্চ ঘাটে পৌঁছানোর আগেই ব্যাগ নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিনব ছিনতাইও রয়েছে।
ধর্ম যার যার উৎসব সকলেরÑ এ সেøাগান সামনে রেখে প্রতিবছর ঈদ আসে। আর সে সময় বেশি ব্যস্ততা দেখা যায়। এই ব্যস্ততা চলে রমজান মাসজুড়ে। ফলে এই সময়ে রাস্তাঘাট-দোকানপাটে মানুষের ভিড় অন্য যেকোনো উৎসবের চেয়ে বেশি হয়। ঈদ সামনে রেখে তাই মাসজুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে এ দেশে। এজন্য ঘরমুখী মানুষের যাত্রা নিরাপদ করতে প্রশাসনের তদারকি বাড়ানো উচিত। সরকারি নির্দেশাবলি বা আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া বাস, লঞ্চ ও স্পিডবোটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ঈদে ঘরে ফেরা অনেক শ্রমজীবী মানুষ বাস কাউন্টার-রেলস্টশন কোথাও টিকেট পায় না। দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে টিকিট সংগ্রহ করা গেলেও পথে পথে ভয়ঙ্কর যানজটে ঈদ মাটি হওয়ার শঙ্কায় তটস্থ হয়ে ওঠে তারা। সড়ক-মহাসড়কগুলো কেবল ঈদ নয় সব সময়ের জন্য সংস্কার করে চলাচল উপযোগী রাখতে হবে। সড়কগুলোতে চলাচলরত আনফিট বা লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা যানবাহন অবশ্যই বাতিল করতে হবে। অধিকাংশ চালকেরই থাকে না বৈধ লাইসেন্স এবং গাড়ির আসল কাগজপত্র। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এসব জেনেও না জানার ভান করে। তাছাড়া বিআরটিএ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের কারণে এসব সমস্যা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে গাড়ির মালিক ও চালকরা যে অনিয়ম করে তা নির্মূল করা জরুরি। সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি আটকে পুলিশের নানা ছুতোয় টাকা আদায়ের বিষয়টি আইনের আওতায় আনতে হবে। এজন্য মহাসড়ক ও রাজধানীর ভিতর সর্বত্রই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসাতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিধি বৃদ্ধি করলে অপরাধ কমে আসবে আর মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে। যাত্রী হয়রানি বিষয়ে মনিটরিং টিম গঠন করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রতারণা-চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে কঠোর হলে মানুষের ঈদ উৎসব সার্থক হবে।
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন