‘জঙ্গিরা আইএসের নিয়োগকর্তা ও ইসলামি বক্তাদের অনুসরণ করত’
শাহরিয়ার খান : শুক্রবার রাতে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা ২০ জন নিরীহ নাগরিককে গলাকেটে হত্যা করেছে। জঙ্গিদের মধ্যে দুজন ইসলামের তিনজন ধর্মপ্রচারককে অনুসরণ করতেন।
এরা হলেনÑ আনজিম চৌধুরী, সামী উইটনেস ও জাকির নায়েক। ২২ বছরের জঙ্গি নিব্রাস ইসলাম আইএসের সন্দেহভাজন নিয়োগকর্তা আনজিম ও সামীকে ২০১৪ সালে টুইটারের মাধ্যমে অনুসরণ করতেন। অন্য আরেকজন জঙ্গি আওয়ামী লীগের নেতার পুত্র রোহান ইমতিয়াজ পিস টিভির ধর্ম প্রচারক জাকির নায়েকের বিভিন্ন বক্তব্য উল্লেখ করে ফেসবুকে সন্ত্রাসী হতে সব মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাতো।
৪৯ বছর বয়সী আনজিম চৌধুরী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। ব্রিটেনে সন্ত্রাসবিরোধী আইন লঙ্ঘন করায় তার বিচার চলছে। ২৪ বছর বয়সী সামী উইটনেস ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর বাসিন্দা। টুইটারে তার নাম মেহেদী বিশ্বাস। আইএসের পক্ষে কাজ করার জন্য সামীর ভারতে বিচার কাজ চলছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সামীকে গ্রেফতার করে ব্যাঙ্গালুরুর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তার টুইটার অ্যাকাউন্টটি ২০১৪ সালের আগস্টে সর্বশেষ সচল ছিল। আর আনজিমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ ওঠার পরে তার টুইটার অ্যাকাউন্টটি ২০১৫ সালের আগস্টে অচল হয়ে যায়।
জাকির নায়েককে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া তার নিজ দেশ ভারতেও তিনি বিতর্কিত হন। বাংলাদেশে তিনি খুবই জনপ্রিয়। পিচ টিভির মাধ্যমে জাকির নায়েক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বাংলাদেশে। ইসলাম ধর্ম ও অন্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রচারের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি পান।
নিব্রাস ও রোহান রাতারাতিই উগ্রবাদী হয়ে ওঠেনি। তারা প্রথমে উগ্রবাদের সামগ্রীর পরিচিতি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে উধাও হওয়ার এক-দুই বছর আগেই তারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় আইএস হিসেবে হত্যাকা-টি তারা এমনিতেই করেনি।
আইএস কি নিয়ে কাজ করছে এমন গণমাধ্যম সাইট ইন্টেলিজেন্সের গ্রুপ তাদের ওয়েব সাইটে ছবি পোস্ট করেছে। ছবি দেখে অনুমান করা যায় এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতরা উধাও হওয়ার পরে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। তাদের বেশভূষা ও পেছনে আইএসের লোগোসহ ছবি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তারা সংগঠিত সশস্ত্র প্রশিক্ষিত। তাদের হামলার ধরন দেখে অপেশাদার মনে হয়নি।
শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানের ১৫ মিনিট আগে কিছু জিম্মিকে মুক্তি দেয় হত্যাকারীরা। তাদের ব্রেইন এমনভাবে ওয়াশ করা হয়েছে তারা মরতেও প্রস্তুত ছিল। এটি আত্মঘাতী হামলার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ছিল।
হত্যাকারীরা শুক্রবার মধ্যরাতে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে হত্যাযজ্ঞের ধূসর বর্ণের ছবি আপলোড করে। পরে সাইট ইন্টেলিজেন্স পুনরায় তাদের ওয়েবসাইটে ছবিগুলো আপলোড করে। সাইটের দাবি আইএস জঙ্গিরা গুলশানে হামলা চালিয়ে ২০ জনকে হত্যা করেছে। পরবর্তীতে এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। তবে নারী সদস্যদের ছবি জঙ্গিরা অস্পষ্ট করে রাখে। জঙ্গিরা দাবি করে নারীদের ছবি প্রকাশ করা পাপ।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম চ্যানেল ফোর নিউজের খবর অনুযায়ী, ভারতের পুলিশ সামীকে গত বছরের জুনে গ্রেফতার করে। আইএসের পক্ষে এককভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী টুইটকারী তিনি। এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৪ সালে চ্যানেল ফোর নিউজের একটি অনুসন্ধানী দল মূল রহস্য বের করে তা প্রকাশ করে।
অনুসন্ধানী দল জানায়, আইটি বিশেষজ্ঞ মেহেদী বিশ্বাসই সামী উইটনেস অ্যাকাউন্টের স্বত্বাধিকারী। লন্ডনের কিংস কলেজের আইসিএসআরের রিসার্চে দেখা যায়, তার দুই-তৃতীয়াংশ ফলোয়ার বিদেশি জিহাদি। এদিকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর সিটি ক্রাইম ব্রাঞ্চ জানায়, বেআইনি কর্মকা-ের জন্য প্রিভেনশন অ্যাক্টের অধীনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার ৩৫ হাজার পেজে ১ লাখ ২২ হাজার টুইট পাওয়া যায়।
আনজিম চৌধুরী একজন আইনজীবী। সোসাইটি অব মুসলিম ল ইয়ার্সের চেয়ারম্যান, ইসলাম ফোর ইউকের মুখপাত্র। টেলিগ্রাফের ২৮ জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আনজিমকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগে। ইউটিউবে বিতর্কিত বক্তৃতা আপলোডের অভিযোগও আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালের ২৯ জুন থেকে গত বছরের ৬ মার্চ পর্যন্ত ‘খিলাফতে’র পক্ষে পোস্ট করেন তিনি। আনজিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আনা হয় সে ইরাক ও সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে তার সমর্থকদের উৎসাহ দিয়েছেন।
জাকির নায়েক একজন জনপ্রিয় ইসলামিক বক্তা। তিনি মুম্বাইভিত্তিক ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ভারতে সালাফি মতাদর্শের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
জাকির নায়েক তার বক্তৃতায় সুন্নিদের ছাড়া অন্য ধর্ম ও মতাদর্শের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় তাকে যুক্তরাজ্য ও কানাডায় নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া মালয়েশিয়ায় যে ১৬ জন ইসলামিক স্কলারকে নিষিদ্ধ করা হয় তার মধ্যে জাকির নায়েকও রয়েছেন। তবে তিনি এপ্রিলে অধিকার কর্মীদের একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে মালয়েশিয়া যান।
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল মালয়েশিয়ার ‘মালাইঅনলাইন’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়া-ভারতীয় ৪০টি সংগঠন পুনরায় জাকির নায়েক যাতে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের অনুমতি না পায় তার জন্য স্বাক্ষর করে। জাকির নায়েক মালয়েশিয়া গেলে তা দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে বলে জানানো হয় সংগঠগুলোর পক্ষ থেকে। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ
ডেইলি স্টার থেকে অনুবাদ করেছেন এম রবিউল্লাহ