জঙ্গিগোষ্ঠীর টার্গেট যখন যুব সমাজ
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জিম্মি সংকটের মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যের প্রশংসা করেছে বিশ্বের সকল দেশ। কেবল জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে নিয়মিত অপরাধী গ্রেফতার নয়, আন্তঃদেশীয় পর্যায়েও সন্ত্রাসী কর্মকা- মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে কর্মকা- পরিচালনার ইচ্ছা প্রকাশ করে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির নাম ও ছবিসহ এক অডিওবার্তায় জিহাদের ডাক দেওয়া হয়। ওই ঘটনা তদন্তেও সরকার আন্তরিকতা দেখিয়েছে। জুন মাসে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার দেশিয় ও আন্তঃদেশীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো মোকাবেলায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখানোয় ২০১৫ সালে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে ‘অগ্রগতি’ করেছে বাংলাদেশ। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বর্তমান সরকার আইন প্রণয়ন, আইনশৃঙ্খলা জোরদার, সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসের অর্থায়ন প্রতিরোধ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সহিংসতা ও সহিংস জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করে দেশকে জঙ্গিরাষ্ট্রের তকমা থেকে রক্ষা করেছে। বিশ্বের বহু দেশে এখন নতুন সমস্যার নাম ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। এছাড়া গোষ্ঠী বা আঞ্চলিকতাকে কেন্দ্র করে একটি চক্র চরমপন্থা অবলম্বন করছে যাতে বিশ্বশান্তি বিঘিœত হচ্ছে। এরা গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অসহনীয় করে তুলছে। এরা আগে বিচ্ছিন্নভাবে এবং সমন্বয়হীনভাবে কাজ করলেও প্রযুক্তির বদৌলতে তারা এখন অনেক বেশি সুসংহত ও সমন্বিতভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের চলাচলের গতি বেড়েছে, যোগাযোগ সহজ হয়েছে এবং আত্মগোপনের জন্য বিস্তীর্ণ এলাকা ব্যবহার করছে। দেশে দেশে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটছে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী সাধারণ মানুষের জানমালের পাশাপাশি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বশান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর মোকাবেলা করা শান্তিকামী সকল মানুষের দায়িত্ব। বাংলাদেশের জনগণ সব সময়ই শান্তির পক্ষে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস নীতিতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। তার সেই আদর্শ অনুসরণ করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এখন স্বীকার করতে বাধ্য, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মুখভাগে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা ৩৫ শতাংশ বেড়েছে এবং আগের বছরের তুলনায় মোট হতাহতের সংখ্যা ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব আক্রমণের ৬০ শতাংশের বেশি পাঁচটি দেশে সংঘটিত হয়েছে। এগুলো হলো- ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত ও নাইজেরিয়া। আর ৭৮ শতাংশের বেশি হতাহত হয়েছে সিরিয়ায়। ২০১৪ সালে ২০টি মারণঘাতী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ১০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে, যেখানে আগের বছর এ ধরনের দুটি হামলার ঘটনা ঘটে। একই বছর বাংলাদেশে বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত হয়নি। বরং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৪-এর ২৯ সেপ্টেম্বর আইএস ও আল-নুসরাহ ফ্রন্টের জন্য জঙ্গি সংগ্রহের অভিযোগে সামিউন রহমান নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সামিউনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ইরাকে ইসলামিক স্টেটস (আইএস) প্রতিরোধে বৈশ্বিক জোটের অংশীদার না হলেও বাংলাদেশ এই হুমকি মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া সহিংস জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে কৌশলগত যোগাযোগ স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর নজরদারি করছে এবং মানসম্পন্ন জাতীয় পাঠ্যক্রম তৈরি করছে, যাতে ভাষা শিক্ষা, গণিত ও বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একইসঙ্গে অষ্টম ধাপ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষায় ন্যূনতম মানের ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়গুলো পড়ানো বাধ্যতামূলক করেছে। এমনকি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে ইমাম ও আলেমদের নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে পূর্ণরূপে সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশ। সন্ত্রাসের কারণে বিশ্ব আজ নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত সহযোগিতা, যা বাংলাদেশ করে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার জোরালো আগ্রহ দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বসন্ত্রাস মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মাটি বিদেশি উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধানদের সম্মেলন (এপিআইসিসি) উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৭টি দেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধানরা ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
গত মহাজোট সরকারের সময় জাতীয় সংসদে ‘সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল ২০১৩’ পাস হয়। অবশ্য মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯’ পাস করে। সেই আইনটিকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজন দেখা দেয় বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ধরন দ্রুত পাল্টানোর ফলে। এজন্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ’ (এপিজি) এবং ‘ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদ- অনুসরণ করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরপর ২০১২ সালে এক দফা আইনটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু তারপরও আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনুরোধ আসে। এসব বিষয় যুক্ত করতেই সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় উক্ত বিলটি পাস করা হয়েছে। এই বিলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ইন্টারনেট ভিত্তিক সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত ধারাসমূহ অন্তর্ভুক্তি। কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সংগঠন ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকা- করলে সাক্ষ্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ সংক্রান্ত তথ্যগুলো প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যাবে। অন্যদিকে এই বিলে জঙ্গিদমনে গুরুত্বপূর্ণ ধারা যুক্ত হয়েছে। আল-কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অস্ত্র বিক্রি ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গিবাদে অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া দুটি প্রস্তাবও আইনে পরিণত করা হয়েছে।
জঙ্গিগোষ্ঠী দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার রয়েছে ব্যাপক সাফল্য। জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নেতাদের গ্রেফতার ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনকে আইনের কাছে উপস্থিত করতে সক্ষম হয়েছে ‘র্যাব’ ও পুলিশবাহিনীর সদস্যরা। মানুষের আস্থার জায়গাটি তৈরি হয়েছে; যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিরল একটি ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত র্যাব দেড় লাখেরও বেশি ব্যক্তিকে বিভিন্ন অপরাধে আটক করেছে। এদের মধ্যে রয়েছেÑ ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, অর্থ পাচার ও প্রতারক, নারী ও শিশু পাচারকারী এবং অপহরণকারী। তাদের তৎপরতায় ১০৫২০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে। এমনকি সন্ত্রাসী গ্রেফতারের অভিযানে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ২০ সদস্য নিহত এবং দু’শরও বেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে এ দেশের সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সন্ত্রাস সম্পর্কে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছে বর্তমান সরকার। জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের। জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক কাউকে নৃশংস অত্যাচার ও খুন করা স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়। তাদের নির্মূল করা এবং যুব সমাজকে বাঁচাতে যা করণীয় তার সবই করতে হবে সরকারকে। জিম্মি সংকট মোকাবেলার পর এখন যুব সমাজকে জঙ্গিবাদের মুঠো থেকে বের করে আনা সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মকা-কে গতিশীল করার জন্য যুব সমাজকেই কাজে লাগাতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন