জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় দেশের কৌশল অত্যাধুনিক নয় নতুন কৌশল ঠিক করা হচ্ছে
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : দেশের জঙ্গি দমনে বিগত সময়ে সব ধরনের উদ্যোগ ও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের দাবি করেছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিরাও তেমনটাই বলে এসেছেন। কিন্তু গুলশানের ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে সেসব কৌশল ও নীতি জঙ্গি হামলাকে তৎক্ষণাৎ মোকাবিলা ও পুরোপুরি দমন করার মতো সক্ষম নয়। এ কারণেই জঙ্গি হামলার পরপরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেও বিদেশি ও দেশি যারা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন তাদের প্রাণরক্ষা সম্ভব হয়নি। এমনকি ভাইবার, ইমো ও অন্যান্য অ্যাপস ব্যবহারসহ জঙ্গিরা যাতে কোনো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারে সেই ধরনেরও ব্যবস্থা পুরোপুরি কাজে আসেনি। সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করলেও সেই পদ্ধতি গুলশানের ঘটনায় কাজে আসেনি। কারণ জঙ্গিরা ঘটনাস্থল থেকে তাদের অপরাশেন, মানুষ হত্যা, হত্যার পর রক্তাক্ত ছবি প্রকাশ ও ঘটনাস্থলের সার্বিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সাফল্যের সব খবরই তাদের নির্দেশদাতাদের কাছে পাঠিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওই সব ছবি গণমাধ্যমও সাইট ইন্টেলিজেন্সেও প্রকাশ পেয়েছে। এ অবস্থায় জঙ্গিদের আধুনিক কৌশল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তাই সরকার জঙ্গি দমনের জন্য নতুন কৌশল নিয়ে চিন্তা করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গুলশানে হামলাস্থল থেকে একটি ওয়াকিটকি ছাড়া জঙ্গিদের নিজস্ব কোনো মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে পারেনি অভিযান পরিচালনাকারীরা। ওই ওয়াকিটকি দিয়ে কার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে এটা এখনও জানা যায়নি। বেসরকারিভাবে ওয়াকিটকির মতো যন্ত্র যেন অপরাধীরা ব্যবহার করতে না পারে তা নিয়ে চিন্তা করছে সরকার।
ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানায়, জঙ্গিরা দেশের কোনো কোম্পানির ফোন ব্যবহার না করে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে ব্যবহার করেছে। তাই আন্তর্জাতিক গেটওয়ে ব্যবহার করে যেসব ফোন ও বিদেশি নম্বর ব্যবহৃত হয় সেসবও নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা জানতে পেরেছি জঙ্গিরা নিজস্ব অ্যাপাস ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা ইমো, ভাইবার, স্কাইপে, হোয়াটসআপ এর মতো যে অ্যাপসগুলো সচরাচর ব্যবহার করা হয় তা ব্যবহার করেনি। হামলার পর গুলশানের ওই এলাকায় নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলেও একটি সূত্র জানায়। কিন্তু তা করা হলেও থেমে থাকেনি জঙ্গিদের ছবি পাঠানো ও তাদের কর্মকা-ের ছবি ও ভিডিও প্রকাশের বিষয়টি। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খতিয়ে দেখছে এক এলাকায় সব কিছু বন্ধ করার পরও কিংবা জ্যামার ব্যবহার করারও পরও কিভাবে তারা কাজ করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র আরও জানায়, আমাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের তরফ থেকে সব সময় বলা হয়েছে গুলশান ও বারিধারায় সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে কোনো ধরনের কোনো হামলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ নিরাপত্তা বেস্টনী ও চেকপোস্ট পার হয়ে কোনো সন্ত্রাসী ও জঙ্গির পক্ষে ওই এলাকায় প্রবেশ করা সম্ভব নয়। অস্ত্র সমেততো নয়ই। কিন্তু গুলশানের ঘটনার পর এটা প্রমাণ মিলেছে নিরাপত্তার জন্য যে বেস্টনী ও বলয় তৈরি করা হয়েছে এবং যে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে তা সহজেই ভেদ করে অস্ত্র, গ্রেনেড ও গোলাবারুদসহ ধারালো অস্ত্র নিয়েও সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব। কেবল তাই নয়, গুলশানে জঙ্গিরা গাড়ি করে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করার মধ্যদিয়ে এটাও প্রমাণ হয়েছে যে, গাড়িগুলো যথাযথ চেক হচ্ছে না। যদি হতো তাহলে ওই দিন জঙ্গিরা একজন জাপানি নাগরিকের গাড়ির পেছনে পেছনে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে পারতো না। তারা ব্যাগসহ সেখানে প্রবেশ করেছে। এটা নিরাপত্তা বাহিনীর ঘাটতি বলেও তারা মনে করছেন। এই ঘটনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কারও গাফলতি আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গুলশান ঘটনার পর গুলশান ও বারিধারার নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর জন্যও কোনো গাড়িতে করে যাতে কোনো সন্ত্রাসী ও জঙ্গি প্রবেশ করতে না পারে, কোনো অস্ত্র, বোমা, গ্রেনেড প্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলা হয়েছে। ১ জুলাইয়ের পর থেকে সেখানে চেকপোস্ট আরও বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে চেকিংও। গুলশান ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে।
আগামীতে এ ধরনের ঘটনায় যাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেই বিষয়গুলোও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র আরও জানায়, জঙ্গিরা যেসব যন্ত্রপাতি, অস্ত্র ব্যবহার করছে এর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারপরও তারা দ্রুত ২০ জনকে হত্যা করেছে। এই দিকগুলো বিবেচনা করে জঙ্গিরা এই বিষয়ে কত পারদর্শী ও তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য এর পাল্টা হিসাবে কি ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে সেই ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর চেষ্টা করেও জঙ্গিদের কর্মকা- ব্যর্থ করে দিয়ে রেস্টুরেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি ও জীবিতদের উদ্ধার করতে পারেনি সেই সব বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখে আগামী দিনের জন্য ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের পুলিশ , র্যাব যে সব অস্ত্র ব্যবহার করে তা আধুনিক নয়, সেটা বলা যাবে না। পুলিশ, র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আধুনিকায়ন করার জন্য আমরা সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। তারা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রও ব্যবহার করছে। প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের জন্য আরও কি কি প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রয়োজন ও অস্ত্র প্রয়োজন, এছাড়াও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরও আধুনিক কি কি ডিভাইস প্রয়োজন সেগুলো আমরা দেখবো। এরপর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিরা বাংলাদেশে যে তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে সেটাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলার জন্য আমাদেরকে আরও কঠোর হতে হবে। সেই সব ব্যবস্থা আমরা নেব। আর ইতোমধ্যে অনেক কিছু আমরা নিয়েছিও। এই কারণে শোলাকিয়ার হামলাটি প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি