সংযোগ স্থল কি ফিলিপাইন দক্ষিণ এশিয়ায় আইএসআইএসের সন্ত্রাসী তৎপরতার বিস্তার
ইমরুল শাহেদ : দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জঙ্গি তৎপরতা ক্রমশই বিস্তার লাভ করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তার প্রধান সংযোগ স্থল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ফিলিপাইন। এ বিষয়ে সিএনএন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, মাত্র দুই বছর আগে যখন একটি ভিডিওতে দেখা গেল দক্ষিণ এশিয়া থেকে সংগ্রহ করা তরুণরা কালো পতাকা তলে আইএসআইএসের হয়ে যুদ্ধ করছে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকেনা যে, এই অঞ্চলে ক্রমশই সন্ত্রাসী দল বেড়ে চলেছে। ইন্দোনেশিয়ায় কিছু জঙ্গি গ্রুপ আইএসআইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের শপথই নিয়েছে। তারা জাকার্তায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। সেই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়ও।
আইএসআইএসের প্রতি সহানুভূতিশীলদের একটি দলও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার শত শত তরুণ এখন সিরিয়া ও ইরাকে সক্রিয় রয়েছে। তারা গঠন করেছে কাতিবাহ নুশানতারা নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। এই সংগঠন থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে আইএসআইএসের হয়ে যুদ্ধ করছে। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে আইএসআইএস সম্পৃক্ত কর্মকা- গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অঞ্চলটি কার্যত ইসলামিক স্টেটে পরিণত হয়েছে বলে বলা যায়।
ফিলিপাইনের এ অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিদের জন্য একটা অভয়ারণ্যে পরিণত হতে পারে। যুদ্ধকবলিত মধ্যপ্রাচ্যের চাইতে এই অঞ্চল তাদের কাছে নিরাপদ স্থান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে আসতে চায় তাদের জন্যও নির্বিঘœ পথ মনে হতে পারে। এমন হতে পারে যে, তারা এখানে এসে নতুনভাবে সংগঠিত হতে পারে, যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে, প্রশিক্ষণ ও অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনাও এখানে বসে করতে পারে। এ ধরনের নজির ইতোমধ্যে স্থাপিতও হয়েছে। সিরিয়াভিত্তিক ইন্দোনেশিয়ার স্বঘোষিত আইএসআইএস নেতা বাহরুমশিয়াহ ফিলিপাইনের মিনদানাও দ্বীপের জঙ্গি আনসার খলিফার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার চেষ্টায় রত আছেন। তিনি এই অস্ত্র ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসির পোসো দ্বীপের আইএসআইএসপন্থীদের সরবরাহ করবেন। এই তৎপরতা পরিচালনার জন্য আইএসআইএসের নিজস্ব নিয়ন্ত্রিত একটা ভূখ- দরকার। আইএসআইএসপন্থী আবু সায়াফ দল ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় সুলু ও বাসিলান দ্বীপগুলোতে তা করতে পেরেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোর প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অক্ষমতা বা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার অভাব। তারা নিজেদেরকে স্থায়ী করার জন্য ব্যবহার করছে ধর্মকে। তাদের ঘৃণাবাচক বক্তব্যকে ন্যায্যতা দিচ্ছে এবং সহিংসতার একটা মারাত্মক ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছে। মালয়েশিয়াতে হয়তো রাষ্ট্র নিয়োজিত মুফতিই প্রকাশ্যে মালয়েশিয়ান নয় এমন রাজনীতিবিদদের বলছেন ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নাস্তিক’। বক্তব্য অনুমোদনের কোনো ভয় নেই তার। অথবা হতে পারে ইন্দোনেশিয়ান সরকারে সহানুভূতিহীন একটি সুনির্দিষ্ট মহল মুসলিম সংখ্যালঘু, উগ্রবাদ এবং অসহনীয় কন্ঠস্বরই বিভিন্ন দেশে দায়মুক্তির কার্যকলাপ অনুমোদন করছে। সুলুতে আইএসআইএসের যে আবাস স্থল রয়েছে তা তিনটি অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু। মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্য, ইন্দোনেশিয়ার সুলেওয়েসি এবং সুলু – ্এই ত্রিভুজেই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক স্থাপন সম্ভব। দুই দেশের সীমান্ত দিয়ে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা অবাধে যাতায়াত করতে পারে। অবৈধ অর্থ উপার্জনের উর্বর ক্ষেত্রও এ অঞ্চলটি। এখানে স্মাগলিং এবং অস্ত্র আনা-নেওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত স্থান। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস বিস্তারে এ অঞ্চলটি বড় ধরনের ভূমিকাই রাখছে বলে বলতে হবে। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত তথ্য বিনিময় করা সত্ত্বেও এ অঞ্চলের জঙ্গি তৎপরতার আগাম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এতে প্রমাণিত হয় এই তথ্য আদান প্রদান যথেষ্ট নয়।
ফিলিপাইনের র্যান্ড কর্পোরেশনের স্টাডি অনুসারে, আবু সায়াফ সন্ত্রাসী গ্রুপকে দমনের জন্য মার্কিন সরকার ২০০২ সাল থেকে ২০১৩ সাল ৪৪১ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনীকে। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলা বিন্দুমাত্র কমেনি। এখন আবু সায়াফ গ্রুপ আগের চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী। কার্যত সুলু থেকে এই সন্ত্রাসী গ্রুপকে মোকাবিলার জন্য আরও বেশি আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন এই এলাকাটি এখন একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠেছে। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের এই জঙ্গি তৎপরতা ও সহিংসতা দেশটির সরকার বরাবরই এড়িয়ে গেছে। এখন সেটা চলে গেছে ফিলিপাইন সরকারের আওতার বাইরে।