বাংলাদেশি মুসলিম মানস ও পিস টিভি
রোজার মাসে দেশের দুইটি প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে ‘মানবকল্যাণে শান্তির ফতোয়া’ দিয়ে বলা হয়েছিল, ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। জমিয়াতুল ওলামা ও হেফাজতে ইসলামের দুইটি পৃথক সম্মেলনে এই ফতোয়া দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পরই আমরা বাংলাদেশের স্মরণকালের ভয়াবহ ‘গুলশান ট্র্যাজেডি’ প্রত্যক্ষ করলাম। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নামে শান্তির প্রশ্নে জাতি নতুন করে দ্বিধাবিভক্ত আলোচনায় জড়িয়ে পড়ল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া চ্যানেলে ডাঃ জাকির নায়েকের ‘পিস টিভি’র সম্প্রচার বন্ধের ঘোষণার পর হতে। ইতোপূর্বে একইভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট তথা উস্কানিমূলক প্রচারণার অভিযোগে (অনেকে বলেন অজুহাতে) শাপলা চত্বরে হেফাজতী কর্মকা-ের সরাসরি সম্প্রচার ঘটনায় ‘দিগন্ত টিভি’র সম্প্রচার বন্ধ হতে দেখেছি। দুটি ঘটনার প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও একই ইস্যু হতে তা উ™ূ¢ত। তা হলোÑ ধর্মভীরুতা বনাম ধর্মান্ধতার তাত্ত্বিক লড়াই। এর জের ধরে ধর্মীয় উগ্রতা বা ‘ধর্মের ব্যাখ্যাজনিত অপব্যাখ্যার অভিযোগে ‘পিস টিভি’র সম্প্রচারে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। একে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি অন্তহীন ইস্যুর দেশে এর পক্ষে-বিপক্ষে প্রকাশ্যে অনেক ধারণা-ভাবনা-মতামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। দোষারোপ আর আত্মপক্ষ সমর্থনের রাজনীতিতে আমাদের প্রশ্নাতীত দক্ষতা যেন আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মভীরু মুসলিম প্রধান এই দেশে বিগত বছরগুলোতে জাকির নায়েক খুব দ্রুত একজন সেলিব্রেটি ইসলামিক স্কলার হিসেব জনপ্রিয়তা পেতে থাকেন। তার এই জনপ্রিয়তা অবশ্য সব সময় প্রশ্নাতীত ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মপ্রচারের আড়ালে তার উদ্দেশ্য ও গতিবিধি নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে ওসামা বিন লাদেন প্রশ্নে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, সমাজে যারা খারাপ বা দুর্জন ব্যক্তি তাদের চোখেই একজন মুসলমান ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। তাছাড়া ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম তা প্রমাণ ও প্রচার ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সামাজিক ইস্যুতে জাকির নায়েক বাণী দিয়ে বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মাটিতে অমুসলিমদের নিজ ধর্মের উপাসনালয় থাকা ঠিক নয়, ইসলামে দাসীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক অগ্রহণীয় নয়, কনডম ব্যবহার ইসলাম সমর্থন করে না, শরিয়া আইন মোতাবেক বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে পাথর ছোঁড়া আইন জায়েজ, অল্প বয়সে সতীত্ব বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকায় মেয়েদের স্কুলে পাঠানো ঠিক নয়, ধর্মের কারণে বউ পেটানো ইসলামের দৃষ্টিতে দোষের নয় ইত্যাদি।
তবে সম্প্রতি আইএস-এর ব্যাপারে তিনি একে ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দিলেও সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের দেশে অশিক্ষিত আর শিক্ষিত মানুষের বিচার বুদ্ধির পার্থক্য মাপার কোনো যন্ত্র যদি আবিষ্কৃত হতো তাহলে দেখা যেত মূল জায়গায় কোনো পার্থক্য নেই। আর তা হলোÑ ধর্মীয় উদ্দীপনার প্যারামিটারে। ধর্মীয় শিক্ষার জাগরণ ও উন্মাদনার মধ্যে সূক্ষè বোঝাপড়ার জ্ঞান ক্ষেত্র বিশেষে একজন সাধারণ মুসলমানকে আত্মঘাতী মুসলিমে পরিণত করতে পারে তা আইএস ইস্যুতে আজ প্রমাণিত।
মধ্যযুগের ইউরোপে যখন রোমান চার্চের দাপট, ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজে অনাচার আর জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করা হচ্ছিল তখন শিল্প-বিজ্ঞান-সাহিত্যের প্রতিভূদের নানামুখী কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল নিজের সৃষ্টিকে তথাকথিত ‘ব্লাসফেমী’র হাত হতে রক্ষা করতে। তিন/চারশো বছর আগে আঁকা শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি বা রেমব্রান্তের আঁকা ছবির ভিতর লুকানো কোড বা তথ্য এখন ‘লেয়ার অ্যামপ্লিকেশন মেথড’ টেকনিকের সাহায্যে উদ্ধার করছেন গবেষকরা। সেই সময়ের ইলুমিনাতি আর ওপাস দাই-এর গোপন ধর্মযুদ্ধ আজ সবার জানা। জাকির নায়েক সরাসরি ধর্মের গোঁড়ামিকে উস্কে না দিলেও গোপনে কারও কারও মানসিক পরিচর্যার জন্য একইভাবে দোষী ও দায়ী সাব্যস্ত হচ্ছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রকে সমর্থন জানাচ্ছেন মুক্তবুদ্ধির শক্তি। কিছুদিন আগেও নানা ইস্যুতে তারা কোণঠাসা ছিলেন খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে। কিন্তু রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরেও এদেশের আরেক বিশাল অংশ চায় পৃথিবীতে সব ধর্মের শান্তির সহাবস্থান, জাকির নায়েকের অবস্থানও তাদের চিন্তার বিপরীত মেরুতে। এর সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্ন উঠেছে এখনও অনেক ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেল ভায়োলেন্স, সেক্স, নোংরা মানসিকতার বেসাতী করছে তার ব্যাপারে আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কি না। আশা করি, এ ব্যাপারেও সীমারেখা নির্ধারণ করা হবে আমাদের দেশিয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যেন বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে। তার মানে আবার এই নয়, মুক্ত বিশ্বকে অবরুদ্ধ করে আরও পেছনের পথে হাঁটা। সুতরাং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জটা আরও গভীর ও তাৎপর্যময়। সীমারেখা নির্ধারণের এই মাত্রাটা নির্ভর করবে সরকারের মানসিকতা ও বুৎপত্তি জ্ঞানের যোগ-বিয়োগে। উন্মুক্ত বিশ্বে যেহেতু কোনো বাঁধাই আজ বাঁধা নয়, সেক্ষেত্রে এককভাবে ‘পিস টিভি’কে জঙ্গিবাদ বিস্তারের একমাত্র নিয়ামক ভাবাটাও বড় মাপের ভুল হবে। আকাশ সংস্কৃতির যুগে এমন অনেক চ্যানেল-মিডিয়া আছে যারা ধর্মের বর্মে মানুষকে আচ্ছন্ন রেখে চলেছে, তা সে যে ধর্মই হোক।
অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও উল্লেখ করা দরকার, পশ্চিম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী এক সময় এদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সর্বাংশে ব্যর্থ হয় তাদের পরিকল্পনা। কারণ বাঙালির মননে রবীন্দ্রনাথের শিকড় এতো গভীরে প্রোথিত তা উপড়ে ফেলা সহজ ছিল না। ঠিক যদি আজকের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তবে দেখব, বিশ্বের অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামি আলোচনা ভিত্তিক ‘পিস টিভি’ বন্ধের ঘোষণায় কতজন দেশি-মুসলমান মনের গভীরে সর্বান্তকরণে তা গ্রহণ করতে পেরেছেন তার কি কোনো জরিপ আছে? এই জরিপ জরুরি। জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের মুখ বন্ধ বিধায় বোঝা যাবে না এই দেশের আম-মুসলমান আদতে কী চায়? মনে রাখতে হবে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমানদের তৃণমূলে যে ধর্মীয় বীজ প্রোথিত তার লেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করা ক্ষেত্র বিশেষে বিপজ্জনক। মডারেট মুসলমানের দেশ হিসেবে পরিচিত দিতে চাওয়া বাংলাদেশে এক পক্ষে সেক্যুলার ফোর্স আর অন্য পক্ষে র্যাডিকেল মুসলমানদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। এই দুই পক্ষে লড়াইটা দিন দিন আরও স্পষ্ট হবে ‘পিস টিভি’ থাকা আর না থাকার বিতর্ক ও আলোচনায়। দেশপ্রেম ও স্বকীয় চিন্তাধারায় আপনি কি জানেন কোন পক্ষে আপনার অবস্থান?
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন