
আইএসের অজানা দিক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২০১৪ সালের ২৬ জুলাই সিরিয়ার ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সিরিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করে। সমন্বিত ওই বাহিনীর নাম জামাআ’ত আহাদুন আহাদ (জেএএ)। অভিযানটির নাম দেওয়া হয়েছিল লায়লাতুল কদর। রমজান মাসের ১৯, ২১, ২৩ তারিখের যে কোনো একরাত। জেএএ এই রাতটিকে বেছে নিয়েছিল আসাদের সেনাবাহিনিকে বিভ্রান্ত করার জন্য। কারণ তিন রাতের যে কোনো এক রাতে হামলা হতে পারে। আর তা আসাদের বাহিনীর জন্য আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব হবে না। তেহেলকা ডটকম
জেএএ আইএস এর অপারেশনাল আর্ম বা বিশেষ অভিযান পারিচালনাকারী বহিনী। এটি মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জঙ্গি সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী। আদর্শিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই বাহিনীটির সদস্য সংখ্যা ২৫ হাজার। সিরিয়ায় আইএস এর মোট পুরুষ যোদ্ধার সংখ্যা ৫০ হাজার। তার অর্ধেকই এই জেএএ এর সদস্য। ইরাকে আইএস এর যোদ্ধার সংখ্যা ৩০ হাজার। সংখ্যার এই হিসাবটি সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস এর দেওয়া। জেএএ এর সদ্যস্যদের বেশিরভাগই চেচনিয়া এবং উত্তর ককেশীয় অঞ্চল থেকে আসা। এদের ‘সার্বিক কমান্ডার’ হলেন, আমির আল বারা সিসানি। এই ইসলামি জঙ্গি নেতাকে একজন কিংবদন্তী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তিনি আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। চেচেন, তুর্কী, ইউরোপীয়ান এবং এমনকি আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিরাও এই জেএএ-তে সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে।
জেএএ টুইটারে খুবই সক্রিয় তৎপরতা চালায়। সংগঠনটির তুর্কী সমর্থকরা একে এই ক্ষেত্রে সহায়তা করে। নতুন প্রোফাইল খোলা এবং হ্যাশট্যাগে নিজেদের বক্তব্যের প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে টুইটারকে নিজেদের প্রচারণার জন্য কাজে লাগায় জেএএ। অথচ আইএস এর বিদেশি যোদ্ধাদের নিয়মিত প্রশংসা করে গেলেও পশ্চিমা বিশ্লেষকরা শুধু সংগঠনটির মধ্যপ্রাচ্যীয় সদস্যদের উপরই আলোকপাত করছে। আসলে ভুরাজনৈতিক কৌশলগত কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আইএস এর এই আন্তর্জাতিক চরিত্রটি উপেক্ষা করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র শুধু পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকাতেই আইএস বিরোধী লড়াই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। আইএস এর এই আন্তর্জাতিকতাবাদি দিকটি পশ্চিমাদের বয়ানে সবসময়ই গরহাজির। অথচ পুরো পশ্চিম এশিয়াকে তোলপাড় করে তোলার পেছনে আইএস এর এই বিশ্ব জোটই প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। আর আইএস এর এই বৈশ্বিক চরিত্রটিই সামাজিকভাবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এবং যুদ্ধ রসদের দিক থেকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কৌশলগতভাবেও ধারণার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা সৃষ্টিকারী হবে আইএস এর এই আন্তর্জাতিকতাবাদি চরিত্র। অথচ পশ্চিমা গণমাধ্যগুলো আইএসকে শুধু মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মরুভুমির বর্বরদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জঙ্গি বাহিনী হিসেবে চিত্রায়িত করে আসছিল। যাদের আদর্শিক অবলম্বন ইসলামের সবচেয়ে গোঁড়া ও রক্ষণশীল মতবাদ- ওয়াহাবি মতবাদ। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার মার্কিন মিত্ররা অবশ্য আইএস এর এই আন্তর্জাতিক চরিত্রটিকেত উপেক্ষা করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আইএসএর ওই যোদ্ধারা আরো বেশি দুর্র্ধর্ষ এবং মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছে। ২০১৪ সালে আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির এক বক্তব্যেও আইএস এর এই আন্তর্জাতিক চরিত্রটি ফুটে ওঠে। বাগদাদি বলেছিলেন, ‘চীন, ভারত, ফিলিস্তিন, সোমালিয়া, আরব উপদ্বীপ, ককেশাস, লেভান্ট, মিসর, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, আহভাজ, ইরান, পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও মরোক্কো এবং পূর্ব ও পশ্চিম সব জায়গাতেই মুসলিমদের অধিকার জোরপূর্বক ক্ষুণœ করা হচ্ছে।’
তার মানে পৃথিবীর যেখানেই মুসলিমদের আবাস রয়েছে সেখানেই ভবিষ্যতে আইএস এর যুদ্ধক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আগের যে কোনো ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে আইএস অনেক বেশি আন্তর্জাতিকতাবাদি মতবাদ লালন করে। ২০১৪ সালের রমজানের প্রাক্কালে আবু বকর আল বাগদাদি তার এক বক্তৃতায় বলেন, ‘মুসলিমরা সবাই নিজেদের রাষ্ট্রে চলে আসো। হ্যাঁ, ইসলামিক স্টেট (আইএস) তোমাদেরই রাষ্ট্র। কারণ সিরিয়া শুধু সিরিয়ানদেরই নয়; ইরাকও শুধু ইরাকিদের নয়। পুরো পৃথিবিটাই আল্লাহ তায়ালার।’ তার এই বৈশ্বিক ডাক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আন্তর্জাতিক জোট গড়ার চেষ্টার চেয়েও অনেক বেশি প্ররোচণামূলক। এতে শুধু একটি একক ও বিশ্ব ইসলামবাদি আদর্শিক প্রকল্পের বাস্তবায়নই নয় বরং এক বিশাল, সীমানাহীন ও রাষ্ট্রহীন ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ডাকও শোনা যায়।
এই ডাকে সাঁড়া দিয়েই চেচনিয়া ও রাশিয়া থেকে ৯ হাজার মোহাজের বা অভিবাসী যোদ্ধা আইএস এ যোগ দিয়েছে। এরা ককেশাস আমিরাত এর প্রতি অনুগত। রাশিয়ার ইসলামি সন্ত্রাসবাদি নেতা ডোকু ‘ডোক্কা’ খামোতাভিচ উমারোভ (১৯৬৪-২০১৩) ২০০৭ সালে ককেশাস আমিরাত গঠনের ঘোষণা দেয়।
এই চেচেন যোদ্ধাদের বেশিরভাগই সিরিয়ায় অবস্থান করছে। এদের একটি ক্ষুদ্র অংশই শুধু আবু বকর আল বাগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি জর্জিয় বংশোদ্ভুত আবু ওমর আল শিসানির (মূল নাম তারখান বাতিরাশভিলি) মতো চেচেন নেতা আল বাগদাদির আনুকুল্য লাভ করেছে। তবে যেসব চেচেন মুজাহিদ ২০০৭ সালে ঘোষিত ককেশাস আমিরাতকেই আইএস এর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয় তারা অবশ্য আল বাগদাদিকে অতটা গুরুত্ব দিতে চায় না। এ কারণে তারা আবু ওমর আল শিসানিরও সমালোচনা করেছে।
যাইহোক, আল বাগদাদির আনুকুল্য পেয়ে আবু ওমর আল শিসানি ২০১৩ সালে সিরিয়ায় আইএস এর উত্তর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হয়। আর ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে আইএস এর সামরিক প্রধানের পদে নিযুক্ত হয়। এর ফলে এই প্রথম আইএস এর শীর্ষ নেতাদের একজন অনারব বংশোদ্ভুতদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হলো। যা আইএস এর আন্তর্জাতিকতাবাদি চরিত্রটিকে আরো বেশি করে ফুটিয়ে তোলে।
তবে চেচেন জঙ্গিদের একটি অংশ অবশ্য আইএস এর ইসলামি খেলাফত ঘোষণাকে অকালপক্ক একটি প্রকল্প হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার সময় এখনো আসেনি।
মরোক্কো থেকে আসা হারকাত শামস আল ইসলাম নামের একটি ইসলামি জঙ্গি সংগঠনও ইরাক ও সিরিয়ায় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে গুয়ান্তাতানামো বে কারাগারের সাবেক বন্দী ও আল কায়েদার সাবেক শীর্ষ নেতা ইব্রাহিম বিন শাকারান, সিরিয়ায় আবু আহমাদ আল মুহাজির নামে পরিচিত। কথিত আছে আল কায়েদার সাবেক এই কমান্ডার আফগানিস্তানের তোরাবোরা ও হিন্দু কুশ পর্বতমালায় যুদ্ধ করেছে। মার্কিন সেনারা তাকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে পাঠায়। গুয়ান্তানামো থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মরোক্কোর জেলেও তিন বছর বন্দী ছিল ইব্রাহিম বিন শাকারান।
ইরাক ও সিরিয়ায় এমন আরো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন রয়েছে যারা সরাসরি আইএস বা নবগঠিত জাবহাত আল আনসার আল দ্বীন কোনেটির সঙ্গেই যুক্ত নয়। কিন্তু প্রতিটি সংগঠনই আইএস এর মতো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। সবকটি জঙ্গি সংগঠনই ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েই য্দ্ধু করছে। আর এই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো সিরিয়ার বিদ্রোহীদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকেও নিজেদেরকে দুরে সরিয়ে রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক জোট কিন্তু আন্তর্জাতিক এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র প্রজ্ঞার পরিচয় দিবে যদি এই বিষয়টি মনে রাখে যে, চেচেন মুজাহিদরাই এক সময় পুরো সোভিয়েত রাশিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ ও আমেরিকান বংশোদ্ভুত আইএস জঙ্গিদের মতো বর্বরতা প্রদর্শন না করেও ঠিক তেমনি এবারও চেচেন যোদ্ধারাই আরেক বিশ্ব পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক জোটের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
