
‘বি’ ফর ‘ব্রে’
যায়নুদ্দিন সানী
স্কুলজীবনের বন্ধুত্বের সম্ভবত একটা আলাদা ফ্লেভার থাকে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝগড়া, সবচেয়ে বেশি মারামারি, ঈর্ষা, ঘৃণা, ক্রোধÑ কী থাকে না এই সময়টায়। তবে সবচেয়ে মজার যে ব্যাপারটা থাকে, তা হচ্ছে, এই সময়টায় থাকে সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব। আর সেই থাকাটা চলে অনন্তকাল। দশ বছর পরে দেখা হলেও কথা শুরু হয় সেই স্কুলজীবনে শেষ হওয়া আলাপের পর থেকে। কমবেশি সবার মতো আমারও সেই স্কুলজীবনের যেমন বেশকিছু আড্ডা বন্ধু আছে, তেমনি কিছু ‘ঝগড়া বন্ধু’। আর আছে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বেশকিছু স্মৃতি।
স্মৃতিচারণে যাওয়ার আগে প্লেয়িং কার্ড বা তাস নিয়ে দুটো কথা বলে ফেলি। অন্য অনেকের মতো, কার্ড খেলা বুঝতে শেখার পর প্রথম যে খেলাটি শিখেছিলাম, তা ছিল ‘স্পেড ট্রাম’। উৎসাহ, আনন্দ আর সাসপেন্সে ভরা এ খেলা খেলার সময় অনেক কিছুই হতো। আলগোছে পাশের বন্ধুর কার্ড দেখার চেষ্টা থেকে ভয়ে ‘প্যালপিটিশান’ শুরু হওয়া, সবই হতো। নিজের খেলোয়াড়ি দক্ষতার ওপর ভরসা না থাকা খেলোয়াড়ের সাথী থাকতেন ঈশ্বর ‘ঈশ্বর প্লিজ দেখো, আমার টেক্কাটা যেন কেউ ট্রাম না করে’। আর দক্ষ খেলোয়াড়রা পাশের জনের চেহারা দেখেই বুঝে ফেলত, ওর হাতে কী কী কার্ড আছে। পাশের বন্ধুটির কাছে ‘টেক্কা’ আর ‘বিবি’ থাকায় যদি নিজের ‘কিং’ ধরা খেত, দুঃখে কলজা ফেটে যেত। তবে আজকের গল্প কার্ডের অন্য একটি খেলা নিয়ে, ‘ব্রে’।
কার্ডের এ খেলাটাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম। অন্যসব খেলায় থাকে জয় কিংবা পরাজয়। কিন্তু এই খেলায় থাকে অন্য একটি ব্যাপারÑ অপমান। অন্যসব খেলায় যেমন একজন কিংবা একটি জুটি জেতে, এ খেলায় হয় উল্টোটা। এখানে একজন পরাজিত হয়, পরাজিত করাই এখানে খেলা। আর পরাজিত খেলোয়াড়ের খেতাব হয়, ‘ব্রে’ বা ‘গাধার ডাক’। খেলার নিয়ম সংক্ষেপে হচ্ছে এরকম। হার্টসের তেরোটি কার্ডের প্রতিটির জন্য এক পয়েন্ট আর স্পেডের ‘বিবি’র জন্য বরাদ্দ বারো পয়েন্ট। এই মিলিয়ে পঁচিশ পয়েন্ট। চার ধরনের কার্ডের কোনো একধরনের কার্ড যে ফেলবে, অন্য সবাইকে সেইধরনের কার্ডই ফেলতে হবে। যদি না থাকে, তবে সে হয় হার্টস কিংবা স্পেডের ‘বিবি’ পাসাতে পারবে। চাইলে অন্য বড় কার্ডও নিজের কাছছাড়া করতে পারবে। প্রতি ডিল শেষে গুনে দেখা হবে কে কত পয়েন্ট পেল। এভাবে চলতে চলতে যে প্রথমে একশত (অবস্থাবিশেষে এই লক্ষ্য পরিবর্তিত হতে পারে) পয়েন্ট পাবে, সে ‘উইনার’ (আসলে লুজার)। সে হয়ে যাবে ‘ব্রে’।
বুঝতেই পারছেন, মাথায় ‘গ্রে ম্যাটারের কমতি থাকায়, এ খেলাটিকে আমি যারপরনাই ভয় পেতাম। কখনও যদি অনন্যোপায় হয়ে খেলতে হতো, অবধারিতভাবে ‘ব্রে’ হতাম। এরপর হঠাৎ একদিন এক দেবতার আবির্ভাব হলো। আমার জীবনের সব দুঃখ ঘুঁচিয়ে, আমাদেরই এক বন্ধুর ভেতর দারুণ এক প্রতিভা জন্ম নিল। ওর উপস্থিতি আমাকে ‘ব্রে’ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাত। ওর খেলতে বসা আমকে নিশ্চয়তা দিত, এই খেলায় আমি চাইলেও আর জয়ী (আসলে পরাজিত) হতে পারব না। দারুণ প্রতিভাধর এ বন্ধুটির নাম আপাতত রাখলাম, ‘বি’। ‘বি’ ফর ‘ব্রে’ নয়, আসলেই ওর নামের অদ্যাক্ষর ‘বি’।
আমাদের বন্ধুমহলে সবচেয়ে বেশি খেলা হতো ‘স্পেড ট্রাম’। এর কারণ সম্ভবত, সবাই এ খেলাটি জানে, এর অর্থ খুব ভালো খেলে তা নয়, এর অর্থ সবাই খেলাটির নিয়ম-কানুন জানে। আর তাই, বন্ধুদের জমায়েতে কেউ এ খেলাটি খেলতে চাইলে চারজন জুটে যেত।’ ব্রিজ’ অনেকেই পারতো না, ‘টুয়েন্টি নাইন’ আমার পছন্দ নয়। আর ‘ব্রে’ ছিল অপছন্দের শীর্ষে। নাহ, বোধহয় ভুল বললাম, বলা উচিত, ‘ভয়ের শীর্ষে’। বন্ধুদের ছাড়া, এখানে-সেখানে কখনও ‘ব্রে’ খেললে, অবধারিতভাবে আমিই হতাম ‘ব্রে’।
‘ব্রে’ খেলার ব্যাপারে, আমার ভয় এবং দুঃস্বপ্ন বিতাড়িত করতে যে বন্ধুটির অবদান সবচেয়ে বেশি, সে হচ্ছে আমাদের এই ‘বি’। অসামান্য প্রতিভাধর আমার এ বন্ধুটি আগে থেকেই ‘ব্রে’ খেলাটি জানত। আমি জানলেও খেলতাম না। যখন দেখলাম খেলতে বসলে, তার ব্রে হওয়া ছিল একেবারে অবধারিত, তখন খেলাটার প্রতি ভয় কেটে গেল। অবস্থা এমন হলো যে, নতুন খেলোয়াড় হোক আর পুরনো হোক, ‘ব্রে’ খেলতে বসলে বিজয়ী(??) হবে আমাদের সেই বন্ধু ‘বি’। কেন? সেই রহস্য আজও আমরা জানতে পারিনি। কারণ, ‘নিউবি’ বা আজকেই খেলা শিখেছে, চারজন হচ্ছে না দেখে যাকে অনেক অনুরোধ করে খেলতে বসানো হয়েছে, তেমন একজন খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও, মহাসমারোহে ‘ব্রে’ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে আমাদের এই বন্ধু, ‘বি’। কখনও এমনও হয়েছে, আমরা বাকি তিনজন খেলোয়াড়, হয়তো একশর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, আর ‘বি’ আছে পনেরোর আশপাশে। তারপরও পরবর্তী তিন বা চার ‘ডিলে’ সে হঠাৎ প্রতি ‘ডিলে’ বিশ কিংবা চব্বিশ নিয়ে, দ্রুতগতিতে আমাদের পেছনে ফেলে পৌঁছে গেছে ‘একশ’তে। এমনও হয়েছে একজন ‘নিরানব্বই’য়ে পৌঁছে গেছে, তারপরও আমাদের এই ‘বি’ তাকে পেছনে ফেলে ‘ব্রে’ শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে।
প্রতিবার খেলায় তার দুর্দান্ত পারফরমেন্স যেমন উপভোগ্য ছিল তেমনি আনন্দের ছিল ‘ব্রে’ হওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া। সেই মাথা দুদিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, ‘আজকে কোনোভাবেই তোরা আমাকে হারাতে পারতি না, আমার একটু ভুলের জন্য’ ছিল আমাদের সবার জন্য দারুণ আনন্দের এক অভিজ্ঞতা। এরপর শুরু হতো স্মৃতি রোমন্থন। কীভাবে, কোন ‘ডিলে’ তার একটু ভুলের জন্য আজকে সে ‘ব্রে’ হলো, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। ‘ইস একটুর জন্য আমাকে ‘বিবি’টা খেতে হলো’ কিংবা ‘আমি চাইলেই বিবিটা পাসাতে পারতাম, কেন যে ধরা খেলাম?’ মোদ্দা কথা, কখনই সে মানতে রাজি হতো না, সে ‘ব্রে’ হওয়ার মতো বাজে খেলোয়াড়। ‘এক্সকিউজ’ তার হাজির। কখনই মানতে রাজি হতো না, সে খারাপ খেলেছে। এখনও তার দৃঢ় বিশ্বাস, ‘ভুল খেলে না, সে হেরেছে নেহাত কপাল মন্দের কারণে’।
এভাবে বেশকিছু দিন চলার পর মজার কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। আসলে বলা উচিত এরপর পরিস্থিতি এক অন্য মোড় নিল। ওর প্রতিক্রিয়া আমাদের কাছে এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠল যে, সেই ‘বাহানা’ শোনার লোভে, নিজেদের অজান্তেই আমরা বাকি তিনজন একটা দলে পরিণত হয়ে যেতাম। বন্ধুদের মধ্যে যে চারজনই খেলতে বসি না কেন, দেখা যেত, বন্ধু ‘বি’ একা আর আমরা বাকি তিনজন একদলে পরিণত হয়েছি। ইচ্ছে করে তাকেই ‘বিবি’ খাওয়াচ্ছি। ‘ফোটা’ পাসানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্য কাউকে দিচ্ছি না, কেবল ওকেই দিচ্ছি। আমাদের নিজেদের ভেতর কেউ একশর কাছাকাছি পৌঁছে গেলে, অন্য একজন তার উদ্ধারে এগিয়ে আসছি। যতটা সম্ভব তার বড় বড় কার্ডগুলো ধরে ফেলছি। সে ফোটা পেতে পারে, এমন সুযোগ এলেই সেই ডিল ইচ্ছে করে কেউ একজন হেরে যাচ্ছি। সর্বোপরি, মজার যে অবস্থা তৈরি হলো, তা হচ্ছে ‘বি’র অবর্তমানে, এই খেলা খেলার উৎসাহই সবাই হারিয়ে ফেলছি। ও না থাকলে, খেলছিই না।
একদিন আলাপছলে একজন ‘কার্ড খেলা বিশেষজ্ঞকে’ আমাদের এ খেলার বর্ণনা দিলাম। উনি জানালেন, ‘এই খেলা তো এভাবে খেলা যাবে না। ‘ফার্স্ট আভাইলেবল চান্সে’ বিবি পাসাতে হবে। তুমি ইচ্ছামতো তো বিবি পাসাতে পারবা না।’ বন্ধু নেচে উঠল, ‘সেজন্যই আমি ব্রে হচ্ছি।’ শুরু হলো নতুন নিয়মে খেলা। তবে ফলাফলের তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। কেমন করে যেন প্রতিবারই আমাদের এই ‘বি’ তার দক্ষতা অব্যাহত রাখল। একেবারে নবিস কাউকে নিয়ে খেললেও তার খেতাব অক্ষত রাখার প্রক্রিয়া চালু থাকল। একসময় দেখা গেল, আমাদের বাকি তিনজনের ভেতর অসৎ ঐক্য গড়ে উঠল। চোখের ইশারায় একে অপরকে বুঝিয়ে দিতাম কার কাছে বিবি আছে। একসময় সে সন্দেহ করাও শুরু করলোÑ ‘তোরা শালারা মনে হয় আমাকে ইচ্ছা করে ‘ব্রে’ বানাস’। প্রমাণের অভাবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব টিকল না। তবে প্রতিবার পরাজয়ের প,ে ‘ইস আজকে একটুর জন্য’ চলতেই থাকল।
একসময় বন্ধুটি পড়াশুনা করতে বিদেশ পাড়ি দিল এবং যথারীতি পড়াশুনা শেষে সেখানে শিকড় গাড়ল। আর সেই সঙ্গে আমাদের ‘ব্রে’ খেলারও পরিসমাপ্তি ঘটল। সময়ও গড়িয়ে চলল। আমরা বাকি সব বন্ধুরাও একে একে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেলাম। চাকরির সূত্রে নিজস্ব আলাদা বন্ধুবান্ধব তৈরি হলো। সেখানেও কার্ড খেলা হতো। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, বাকি সব খেলা খেললেও, ‘ব্রে’ খেলার কোনো ইচ্ছা কখনই আর জাগত না। ‘বি’ ছাড়া ‘ব্রে’ খেলার কোনো মানেই হয় না। আমাদের সব স্কুল-বন্ধুদের জীবন থেকে কার্ডের খেলাগুলোর ভেতর থেকে এ খেলাটি হারিয়ে গেল। কেবল যখন বিদেশ থেকে ছুটিছাটায় ‘বি’ দেশে আসত, তখন আমাদের জীবনে অমোঘ আনন্দ নিয়ে ফেরে ‘ব্রে’ খেলা। ফিরে আসত সেই স্কুলজীবন। আর ফিরে আসত সেই খেলা শেষের খেদোক্তি, ‘ইস আজকে একটুর জন্য’।
