ইসলাম নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন
শামিম আহমেদ
ঢাকার গুলশানকা-ের পর বেশ কিছু তর্কের অবকাশ তৈরি হয়েছে। উঠছে নানা প্রশ্ন। সরাসরি ঢুকে পড়া যাক সেই তর্কের পরিসরে।
তর্ক : ১
ঢাকার ঘটনা একটি বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে। শুধু দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মাদ্রাসায় পড়া যুবকদের জঙ্গি বানানো হয়Ñ এ ‘মিথ’টির কোনো ভিত্তি নেই। ঢাকার জঙ্গিরা তা প্রমাণ করে দিয়েছে। নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সন্ত্রাসধর্মে দীক্ষা নিয়ে আত্মঘাতী হামলায় জড়িয়ে পড়ার পিছনে কি কেবলই পরকালের বিলাসী জীবনের হাতছানি? না কি ইহলোকের অশিক্ষাও কাজ করছে? এই তর্ক-বিবাদ চলতেই থাকবে। পাশাপাশি, সবাইকে ছেড়ে নারকীয় হত্যাকা-ের অন্যতম অভিযুক্ত খাইরুলের গরিব মা-বাবাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হবে আর ধনী পিতা-মাতারা থাকবেন হেফাজতের বাইরে।
তর্ক : ২
ঈদের দিন কিশোরগঞ্জে সমবেত প্রার্থনায় হামলার ছক কষা হলো কেন? সন্ত্রাসীরা তো ‘ইসলাম’ ধর্মে বিশ্বাসী! তা সত্ত্বেও তাদের নিজেদের ভাই-বেরাদরদের উপর এই আক্রমণের পরিকল্পনা কেন? উত্তর জটিল। সন্ত্রাসবাদীদের ধারণা, ঈদের নামাজ ‘সহি ইসলামে’র অঙ্গ নয়। তবে যে এতদিন ঈদের দুরাকাত ওয়াজেব নামাজ সারা মুসলিম জাহান পালন করে এলো! কোনটা সহি আর কোনটা জাল তা নির্ধারণ করবে তারাই, যাদের হাতে অস্ত্র আছে। অস্ত্রের শক্তিতেই ব্যাখ্যা হবে ধর্মের। এবং সেটিই মানতে হবে সকলকে।
তর্ক : ৩
‘সহি ইসলাম’-এর রক্ষক অস্ত্রধারীরা মক্কার কাবা উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষেছে। কী কারণ? ওই যে! কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়া হয়! কাবার দিকে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া, সেখানে গিয়ে কালো পাথরে চুম্বন করা, এ সবই নিরাকার সাধনার পরিপন্থি। সুতরাং, কাবা রাখা যাবে না। সপ্তম শতাব্দীতে এজিদের সেনাপতি বিন নুমাইর একবার চেষ্টা করেছিল কাবা ধ্বংস করার। সে পারেনি তো কী হয়েছে, তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারীরা তো আছে! আর উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেসব মাল-মসলার প্রয়োজন, তা-ও আছে। টাকা দেওয়ার জন্য আছেন ধনকুবের, তেলকুবের, বহু বহু গৌরী সেন।
তর্ক : ৪
সন্ত্রাসীরা বলছে, রাখা যাবে না ‘মসজিদ-এ-নব্বি’ও। কদিন আগেই হামলা চালানো হয়েছিল সেখানে। একটুর জন্য ফসকে গেছে। তবে বোঝাই যাচ্ছে, আরও চেষ্টা হবে। মদিনায় যেখানে নবি মুহাম্মাদের কবর, সেখানেও হয় কবরপূজা। পরম সত্তার সঙ্গে এই অংশীদারিত্ব (শিরক) সন্ত্রাসবাদীরা বরদাস্ত করতে নারাজ। পবিত্র গ্রন্থের যতই মারফতি ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন! যাদের হাতে অস্ত্র, তাদের ব্যাখ্যাই শ্রেষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। না-মানলেই হত্যা।
তর্ক : ৫
আসল খেলা শুরু। ইসলামবিরোধী মৌলবাদীরা এখন দাবি তুলছে, কুরআন সন্ত্রাস ছড়ায় এবং তাকে নিষিদ্ধ করা হোক। তারা বলছে, এই তো অমুক জায়গায় ধর্মযুদ্ধের কথা লেখা আছে। তমুক হাদিস বলেছে যে, বিধর্মীদের কচুকাটা করো। সুতরাং, ইসলাম বর্জনীয়। শান্তি নয়, ইসলাম আসলে সন্ত্রাসের ধর্ম। সঙ্গে ঘৃণা আর গালিগালাজ। যাঁরা আম-মুসলমান, তাঁরা আসলে সন্ত্রাসীদের দোসর। এমনই তো হওয়ার কথাছিল। এমনই তো চেয়েছিল জঙ্গিরা!
এবার বুঝুন ঠ্যালা ! মুসলিমদের কাছে এ যেন শাঁখের করাত। একদিকে চাপাতি- বোমার চোখ রাঙানি। অন্যদিকে, অমুসলিম মৌলবাদীদের ঠাট্টা, তামাশা, নিন্দা, কটূক্তি।
তর্ক : ৬
যাদের সঙ্গে রোজ কাজ করি, আড্ডা দিই, তাদেরও কেউ কেউ কেমন যেন পাল্টে গিয়েছেন। যেসব বন্ধুদের নানা লেখা পড়ি সোস্যাল নেটওয়ার্কে, তাদের মন্তব্যও বেসুরো ঠেকছে। তারা মুসলিম বন্ধুদের ‘সন্ত্রাস-অনুষঙ্গ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পিছপা হচ্ছেন না। তারা বলছেন, ওই সন্ত্রাস-হামলার দায় তো ইসলামের উপরেই বর্তায়! যেহেতু তুমি মুসলমান, তাই তোমাকেও তা বইতে হবে। এ দায় তোমারও। আর না-হলে প্রমাণ করো, তুমি সন্ত্রাসবিরোধী। অগ্নিপরীক্ষা দাও। চেনা মানুষই যদি পরীক্ষা দিতে বলেন, অচেনা মানুষেরা তো বলবেনই। খিস্তি- খেউড়ে ভরছে চারপাশ। ইসলামের বাপ-বাপান্ত করে ছাড়ছেন অনেকেই। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গালাগালি চালিয়ে যাচ্ছেন কিছু ‘অশিক্ষিত’ মুসলিমও। এই ‘অচেনা’রা অনেকেই আবার পূর্ব পরিচিত।
তর্ক : ৭
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটা জিনিস বুঝতে শিখে গিয়েছে। এই পৃথিবীটা দুভাগে বিভক্ত। একদিকে ইসলাম। অন্যদিকে অ-ইসলাম। ইসলামের নানা ‘নুয়ান্স’ তারা জানবে না। জানবে না অ-ইসলামের নানা বৈচিত্র্য। শুধু ঘৃণার বাতাসে শ্বাস নেবে। ‘তবে কী হবে?’ বহুদিন আগে প্রশ্ন করা হয়েছিল এক ধর্মগুরুকে। আলোচনার প্রেক্ষিতে এক শিষ্য বললেন, ‘ধর্মই পৃথিবীতে শান্তি আনতে সক্ষম।’ ধর্মগুরু বললেন, ‘ঠিক বলেছ।’ শুনে অন্য এক শিষ্য বললেন, ‘মোটেই না। ধর্ম দুনিয়ায় সন্ত্রাস বয়ে আনে।’ ধর্মগুরু এবারও বললেন, ‘ঠিক বলেছ।’ ধর্মগুরুর স্ত্রী প্রচ- খেপে গিয়ে স্বামীকে বললেন, ‘তোমার কোনো নীতি-আদর্শ নেই। এই বললে ধর্ম শান্তি আনে, আবার পরক্ষণেই বলছ, ধর্ম অশান্তি আনে ! ছিঃ!’
ধর্মগুরু আবার জবাব দিলেন, ‘তুমিও ঠিক বলেছ। আসলে ধর্ম হলো কবিতার মতো। তার নানা ব্যাখ্যা।’
লেখক : বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে দর্শন বিভাগের প্রধান। মতামত নিজস্ব)।