জঙ্গি হামলার আশঙ্কা দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার
সূজন কৈরী : হঠাৎ করেই আবারও দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সব স্থাপনা, দেশের সব কারাগার, আদালত পাড়া, শপিংমল, সরকারি বহুতল ভবন, সচিবালয়, জাতীয় সংসদ, কূটনৈতিক এলাকা, মন্ত্রীপাড়া, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এসব স্থাপনাগুলাতে র্যাব-পুলিশ, এপিবিএন, এসপিবিএন, আনসার, বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা ১৭ বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যা করে। এর এক সপ্তাহের মাথায় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জমায়েতের কাছে জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়। নজিরবিহীন ওই হামলার প্রেক্ষাপটে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীরা দেশে আরও হামলার পরিকল্পনা করছে জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
সরেজমিনে রাজধানীর মন্ত্রীপাড়া, জাতীয় সংসদ ভবন, মিন্টু রোড, সচিবালয়সহ বিভিন্ন শপিংমল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এসব স্থাপনার সব প্রবেশ পথেই বসানো হয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। এছাড়া বেড়েছে পুলিশি টহল। ডিএমপির মিন্টু রোডের মিডিয়া সেন্টারে যেতেও সাংবাদিকদের গতিরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এছাড়া গোয়েন্দা কার্যালয়ে যেতেও পরিচয়পত্র দেখাতে হচ্ছে পুলিশকে। মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। কোনো ব্যক্তিই ছাড় পাচ্ছেন না পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ থেকে।
গুলশান, বনানী এবং শূটিং ক্লাব পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পয়েন্টে চলাচলকারী সব ধরনের যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। গুলশান-বনানী-বারিধারায় যাওয়ার প্রতিটি সড়কেই বসানো চেকপোস্টে চলাচলকারী প্রত্যেক নাগরিককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সন্তেুাষজনক উত্তর পাওয়ার পরই ওইসব এলাকায় প্রবেশের অনুমতি মেলে। একজন ব্যক্তিকে কয়েকটি চেকপোস্টে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। মিন্টু রোডের পশ্চিম মাথা থেকে হেয়ার রোড হয়ে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত রয়েছে এ ধরনের আরও কয়েকটি চেকপোস্ট। ইস্কাটন গার্ডেন এলাকা থেকে মন্ত্রিপাড়ার দিকে যাতায়াতের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে চেকপোস্ট দেখা গেছে। কয়েকটি রাস্তায় যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি চেকপোস্টের সামনে পুলিশ সদস্য সতর্ক অবস্থানে থেকে নজরদারি ও তল্লাশি চালাচ্ছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি দুটি বড় জঙ্গি হামলার পর রাজধানীসহ দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ মোতাবেক ঈদের দিন দুপুর থেকে মন্ত্রিপাড়ার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। চেকপোস্টে হালকা যানবাহনের পাশাপাশি পথচারীদেরও গতিরোধ করে দেহ তল্লাশি করা হচ্ছে। এছাড়া কূটনৈতিক জোন খ্যাত গুলশান-বারিধারা-বনানীসহ আশপাশের এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশের তিনটি বিভাগের পাশাপাশি র্যাব ও বিজিবি সদস্যরাও পৃথকভাবে কাজ করছে। বাড়তি সতর্কতা হিসাবে তল্লাশি চৌকিতে যুক্ত করা হয়েছে ভেহিক্যাল মিরর ও বডি স্ক্যানার। তল্লাশি থেকে মন্ত্রীর গাড়িও বাদ দেওয়া হচ্ছে না। মিন্টু রোডের পূর্বপাশে পুলিশের চেকপোস্টে যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সাধারণ যানবাহন ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পরই রাজধানীর মন্ত্রিপাড়াসহ ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের বাসস্থান ও চলাচলের পথগুলোসহ কয়েকটি এলাকায় প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে মিন্টুরোডের চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। কয়েকটি রাস্তায় যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মোড়গুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বায়তুল মোকাররমসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়ছে। সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। গুলশান, বারিধারার কূটনৈতিক এলাকাগুলোতে ৩ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই কারা নিরাপত্তা জোরদার করেছি। কারাগারের চারপাশ ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া কারাভ্যন্তরে ৬ টি ওয়াচ টাওয়ার ও ২০ টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সব স্থাপনার নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ প্রদান করেন। নিরাপত্তা জোরদার করাসহ আগন্তুকদের উপর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসি ক্যামেরা, আর্চওয়ে গেইট স্থাপন, মেটাল ডিটেক্টর, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র সংরক্ষণসহ যাবতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেন তিনি। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ‘নিরাপত্তা সচেতনতামূলক পদক্ষেপ’ নিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পল্লী বিদ্যুতের জনসংযোগ কর্মকর্তা ওমর ফারুক।
এছাড়া বুধবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালতপাড়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন, আইনজীবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত একাধিক বৈঠকে নিরাপত্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের দুটি গেট ছাড়া বাকি প্রবেশ পথসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। আদালত চত্বরে যানবাহন প্রবেশের ক্ষেত্রে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বলেন, বিচারক, আইনজীবী ও কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কারও গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। তবে আইনজীবীদের বার অ্যাসোসিয়েশন প্রদত্ত স্টিকার ব্যবহার করতে হবে। নির্দিষ্ট স্টিকার ছাড়া কোনো গাড়ি আদালত অঙ্গনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আর গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য আইনজীবী সমিতির পাশের খালি জায়গা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হবে। প্রয়োজনে কিছু ছোট গাছ কেটে পার্কিংয়ের জায়গা বাড়ানো হবে। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি