শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে দুয়োর বেঁধে রাখ
আমি যখন এ লেখা লিখছি ফ্রান্সে আবারও হামলার শিকার হয়েছেন নিরীহ জনগণ। এবারের হামলার রূপ ভিন্ন। ট্রাকে ঢুকিয়ে সমাবেশে মানুষ মারার এমন করুণ ও লোমহর্ষক ঘটনা আগে কখনও দেখিনি। সভ্যতার পাদপীঠ ফরাসি দেশ। বাস্তিলদূর্গের কাহিনী জানে না এমন সভ্য মানুষ দুনিয়া বিরল। ফরাসি বিপ্লব না হলে জগত সংসারে রাজতন্ত্র আর পরিবারতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটত না। শুধু রাজনীতি? শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ফ্রান্সের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ। আমরা যখন ছোট তখন জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকে প্রয়াত হেদায়েত হোসাইন মোরশেদের অনূদিত লা মিজারেবেল প্রকাশিত হতো। একটি কিস্তিও বাদ দিইনি। পরে জেনেছি, ভিক্টোর হুগোর এই উপন্যাস মূলত সাহিত্যে অন্তজ বা গরিব শ্রেণির প্রবেশের সূতিকাগার। এর আগে মানুষ ভাবত রাজরাজড়া জমিদারদের জীবন প্রনয় প্রেমই হবে উপাখ্যান। আমাদের রবীন্দ্রনাথও কিন্তু গদ্যে অভিজাত শ্রেণির বাইরে পা রাখতে পারেননি। ফরাসি বিপ্লবের পর সাহিত্যে চিত্রকলায় প্রান্তিক মানুষের জীবন উঠে আসতে শুরু করে। বাস্তিলদূর্গ পতনের দিবসটি পালনের সময় ট্রাক নিয়ে এভাবে ঢুকে পড়া আর রাস্তা, ঘাটে, পথে, প্রান্তরে মানুষের লাশ রক্তাক্ত শরীর ছড়িয়ে দেওয়া আজকের দুনিয়া কি আবার প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যেতে চাইছে? একোন কঠিন সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা?
ফ্রান্সে হামলার ঘটনা নতুন না। কোনো এক অজানা বা জানা কারণে এদেশটির ওপর জঙ্গিদের আক্রোশ খুব বেশি মনে হচ্ছে। অথচ দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকা, বিলেত বা আরও কয়েকটি দেশের মতো প্রকাশ্য কোনো বৈরিতা বা উস্কানিতে নেই। তারপরও এদেশের জনগণের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলার মানে কি এই যে তারা আলজেরিয়ার মতো দেশ থেকে বা অন্যান্য দেশ থেকে মানবাধিকারের প্রশ্নে মানুষ এনে ভুল করেছিল? জানি আমাদের মাতবররা মেতে উঠবেন প্রতিবাদে। লিস্ট দিতে থাকবেন কলোনিজিম বা উপনিবেশের ফলে কি কি হারিয়েছি বা কোন কোন দেশ কি হারিয়ে কি পেয়েছে। ভাইসব একটা কথা জেনে রাখুন, আমরা যাদের কলোনী ছিলাম তারা দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন বানিয়ে দিয়ে গেছিল। তারপর প্রায় সত্তর বছর পর আর এক ইঞ্চিও বাড়াতে পারেনি। অথচ পাশেই পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার। আমাদের কলোনীওয়ালারা চা খাওয়ানো শিখিয়েছিল বলে আমরা সকালে চা আর সংবাদপত্র বা মিডিয়া গিলি। এজাতির প্রথম লাইব্রেরিটাও করে দিয়েছিলেন ডিরোজিও। আর ফ্রান্স এমন এক দেশ যার কলোনীতে বিবাদ থাকলেও তারা চলে আসার পর দেশ টুকরা হয় না। ডিভাইডেন রুল বা ধর্ম কিংবা অন্য কোনো বিভাজনের নিয়ম মানে না ফরাসিরা। আজ তাদের দেশে যা ঘটছে তাতে আপনি আমি বাংলাদেশি বলে বা ধর্ম বিশ্বাস ও অন্যান্য কারণে মনে মনে খুশি হলে কোনো লাভ হবে না। জেনে রাখুন, আমরাও এর শিকার হবো একদিন।
আগেই লিখেছিলাম খোলা মিডিয়া মানেই কিন্তু আপদ ও সম্ভাবনা। এর ভালো দিকটা যেমন আমরা নেব খারাপ দিকটাও ছেড়ে কথা বলবে না। মধ্যপ্রাচ্য দেখে, আইএস দেখে, যৌনদাসী দেখে, অন্ধত্ব দেখে আমরা এযাবৎ কি কি শিখেছি আর কি নিয়েছি সেটা ভাবলেই কাহিনী পরিষ্কার হয়ে যাবে। এঘটনা থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নামের যে অন্ধ লোকটি চোখে দেখেন না তার ভাষায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটানোর নায়করা চুপ থাকবে না। আমরা বড় জটিল সমাজের মানুষ। কবিকেও দু’চার ভাগে ভাগ করি। আল মাহমুদের নাম বললে যারা মনে করেন, আমরাও অন্ধ বা রাজাকার তাদের তার একটি অমোঘ ছড়ার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই,
ট্রাক ট্রাক ট্রাক/শুয়োর মুখো ট্রাক এসেছে দুয়োর বেঁধে রাখ…
ফ্রান্সের ধাবমান ট্রাক যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে। ফরাসি সৌরভের নাম ও খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। সেদেশের সৌরভ ও রক্ত একাকার হয়ে যাবে একদিন? এই-ই সভ্যতার দান?
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন