‘পুরো নিস শহর যেন আতঙ্কে দৌড়াচ্ছিল’
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফ্রান্সের নিস শহরে বাস্তিল দিবসের উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার ওপর দ্রুত গতিতে ট্রাক ছুটিয়ে চালানো হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। বিডিনিউজ
ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বিখ্যাত প্রমেনেদ দেজাঙ্গলে চত্বরে বুধবার রাতে আতশবাজি প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পরপর ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ২৫ টনি ট্রাক চালিয়ে দেয় এক চালক। প্রায় দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করে ট্রাকটি থামায় পুলিশ। ট্রাকে পাওয়া যায় অস্ত্র ও গ্রেনেড। প্যারিসে ইসলামী স্টেট জঙ্গিদের হামলায় ১৩০ জন নিহত হওয়ার আট মাসের মাথায় ফ্রান্সজুড়ে জরুরি অবস্থার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে হামলার দায় স্বীকার না করলেও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অলন্দ একে সন্ত্রাসী হামলা বলেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর একজন স্থানীয় এক পত্রিকার সাংবাদিক ডেমিয়েন আলেমান্দ লিখেছেন, আতশবাজি শেষে চিৎকার ও কান্নাকাটির শব্দ শোনার সময় তিনি ছিলেন সাগরপাড়ে।
‘সেকেন্ডের অনেক কম সময়ের মধ্যেই দেখতে পাই, বিশাল সাদা রঙের একটি ট্রাক উন্মাদের মতো ছুটছে; যাতে অনেক বেশি মানুষকে চাকার নিচে পিষে ফেলা যায়।
‘ট্রাকটি যেখান দিয়ে যাচ্ছিল সেখান দিয়েই ছিটকে পড়ছিল মানুষ; যে শব্দ আর কান্না আমি শুনেছি তা কখনও ভুলব না।’
ফরাসি সংবাদমাধ্যমে যেসব আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়েছে তাতে সাগর তীরের পাম গাছে শোভিত প্রমেনেদ দেজাঙ্গলে চত্বরে সমবেত মানুষকে প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। নিসের স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াসিম বোলেল জনতার ওপর দিয়ে ট্রাকটি চলে যাওয়ার ঘটনা দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘রাস্তায় ম্যাসাকার হয়েছে। সব জায়গায়াই পড়ে ছিল লাশ আর লাশ।’
হামলার পর নিরাপত্তার কড়াকড়ি, হাত মাথার উপরে রেখে রাস্তা পার হচ্ছেন নাগরিকরা হামলার পর নিরাপত্তার কড়াকড়ি, হাত মাথার উপরে রেখে রাস্তা পার হচ্ছেন নাগরিকরা ওই চালক কীভাবে ট্রাকটি থেকে নেমে গুলি চালানো শুরু করেন সে কথাও জানান তিনি।
স্থানীয় প্রশাসনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিলভি টোফিন জানান, নগরীর সাগর তীরবর্তী পাঁচতারকা হোটেল প্যালাইস ডি লা মেডিটির্যানির কাছের ফুটপাথের পাশ দিয়ে যাওয়া দীর্ঘ রাস্তায় জড়ো হওয়া উৎসবমুখর মানুষের ওপর দিয়ে চলে যায় ট্রাকটি।
কাছের একটি হোটেল থেকে মর্মাস্তিক ওই ঘটনা দেখতে পাওয়ার কথা জানান ব্রিটিশ পর্যটক কেভিন হ্যারিস। তিনি বলেন, ‘প্রচ- চিৎকার ও কান্নাকাটির শব্দে বারান্দায় গিয়ে দেখি, রাস্তায় পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। দেহগুলো সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। … আশপাশে অনেক পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্সও আছে। কিন্তু এটা ভয়ানক, খুবই ভয়ানক দৃশ্য।’
আতশবাজি উৎসব দেখতে যাওয়া কেলা রিপন নামের যুক্তরাষ্ট্রের এক পর্যটককে উদ্ধৃদ করে বিবিসি লিখেছে, ‘পুরো শহরই যেন দৌড়াচ্ছিল। খুবই ভয় পেয়েছিলাম এবং প্রমেনেদ থেকে পালিয়ে এসেছি।’
জোয়েল ফেনস্টার নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন, ‘সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল এবং আমরা হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ মানুষ দৌড়াতে শুরু করল। মানুষ চিৎকার করছিল, পুলিশের সাইরেন বাজছিল এবং পুলিশ সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলছিল।
‘পরিবেশটা ছিল খ্বুই আতঙ্কজনক। কারণ, আমরা জানি না কী হচ্ছে। আমরা শুধু কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম এবং লোকজনকে অস্ত্র নিয়ে দৌড়াতে দেখছিলাম। এক পর্যায়ে আমরাও দৌঁড়াতে শুরু করলাম এবং দেখতে পেলাম লোকজন আমাদের দিকে ছুটে আসছে। এসময় কিছু লোককে দেখলাম রাস্তায় বসে আছে; যারা যে কোনো উপায়ে পালাতে চাইছিল।
‘সেখানে অনেক পরিবার ছিল। আমরা একটি গাড়ির আড়ালে আশ্রয় নিয়ে দেখি এক মা তার ছোট্ট মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে’।’
ভয়াবহ ওই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশু রয়েছ এবং গুরুতর আহত হয়েছে অনেক শিশু। স্থানীয় লেনভাল শিশু হাসপাতালের কর্মী লরেন্স মেরি জানান, সেখানে অনেক শিশুর জটিল অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে।
ফ্যানি নামের ২০ বছর বয়সী এক নারী রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা সবাই অনেক আনন্দ করছিলাম। সারারাতই উৎসব করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। আতশবাজির পর হাটা শুরু করতেই দেখি পথচারীদের এলাকায় খুব দ্রুত গতির একটি ট্রাক এলোপাতাড়িভাবে ঢুকে পড়ছে।
‘প্রথমে মনে হচ্ছিল, ট্রাকটি হয়তো বুঝতে পারেনি যে উৎসব উপলক্ষে রাস্তাটি পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর রাস্তার ওপর লোকজনকে ছিটকে পড়তে দেখে মনে হচ্ছিল, এটা সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।’