নিহত ৮৪, আহত শতাধিক, ৩ দিনের শোক জরুরি অবস্থার মেয়াদ ৩ মাস বাড়ল সন্ত্রাসীহামলায় আবারও রক্তাক্ত ফ্রান্স
ইমরুল শাহেদ :
ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় নিস শহরে বাস্তিল দিবসের উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার ওপর দ্রুতগতিতে ট্রাক চালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। প্যারিসে ইসলামী স্টেট জঙ্গিদের হামলায় ১৩০ জন নিহত হওয়ার ৮ মাসের মাথায় ফ্রান্সজুড়ে জরুরি অবস্থার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতের এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও প্রায় অর্ধশত মানুষ। পুলিশ চালককে গুলি করে হত্যার পর ট্রাক থামিয়েছে। ঘটনার পর পুরো এলাকায় রক্তের স্রোত বয়ে যায়। এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছেন।
এর আগে বাস্তিল দিবস উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ গত ৮ মাস ধরে জরুরি অবস্থা বজায় রাখার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার ইঙ্গিত দেন। কিন্তু নিস শহরে হামলার পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানোর ঘোষণা দেন। ঘোষণা করা হয়েছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক।
ফ্রান্সের স্থানীয় সময় তখন রাত সাড়ে ১০টা। বাংলাদেশ সময় ভোর প্রায় ৫টা। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের ভূমধ্যসাগরীয় নগরী নিসে জাতীয় দিবস ‘বাস্তিল ডে’ উদ্যাপন উপলক্ষে আতশবাজি উৎসব দেখতে সমুদ্র সৈকতে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। উৎসব শেষে তারা যখন বাড়ি ফিরছিলেন, সেই সময়েই ভিড়ের মধ্যে একটি সাদা রঙের ২৫ টনি ট্রাক প্রায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে ঢুকে পড়ে। ট্রাকের চাকায় পিষে যেতে থাকে একজনের পর একজন। এই সমবেত মানুষের উপর ট্রাকহামলায় ১০ শিশুসহ অন্তত ৮৪ জন অকুস্থলেই নিহত হন এবং গুরুতর আহত হন ৫০ জন। এর মধ্যে ২ শিশু নিহত হয়েছে ঘটনাস্থলে এবং ৮ শিশু মারা গেছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর। আরও গুরুতর আহত ২৮ শিশুকে ঘটনাস্থলের কাছেই একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে আহতদের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রক্তদানের জন্যও সকলকে আহবান জানিয়েছে।
এই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২ জন মার্কিন নাগরিক এবং ২ জন কানাডার নাগরিক রয়েছেন। জানা গেছে, হামলাকারীর হাতে অস্ত্র বলতে ছিল একটি হ্যান্ডগান। আর যে অস্ত্রগুলো ছিল সেগুলো ছিল অকেজো।
ডেইল মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলাকারীর এ তা-ব চলে প্রায় আধা ঘণ্টা। ফ্রান্সের সরকারি কৌঁসুলি বলেছেন, ট্রাকটি দুই কিলোমিটার পর্যন্ত আঁকাবাঁকাভাবে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ট্রাকে শুধু চালকই ছিল। প্রথমে ট্রাক থেকে গুলি ছোঁড়া শুরু হয়। এর পর ভিড়ের মধ্য দিয়েই চালিয়ে দেওয়া হয় ট্রাক। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েক জনের প্রাণ যায়। ভিড়ের উপর ছুটে আসা ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন মানুষজন। চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যান অনেকে। অনেকের দেহ টানতে টানতে অনেকটা দূরে নিয়ে যায় ট্রাকটি। এ ভাবে মানুষজনকে টেনেহিঁচড়ে প্রায় দু’কিলোমিটার নিয়ে যাওয়া হয়। এতে ঘটনাস্থলেই অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশের দাবি, ট্রাকচালককে গুলি করে মারা হয়েছে। গুলিতে ট্রাকের সামনের অংশ পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সামনেটা গুলিতে প্রায় ঝাঁঝরা।
ঘটনার পরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ জরুরি বৈঠকে বসেন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। জরুরি অবস্থার মেয়াদ তিনি আরও তিন মাস বাড়িয়ে দিয়েছেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মেনুয়াল ভালস ৩ দিনের শোক ঘোষণা করেন।
এর আগে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর প্যারিসে ফুটবল স্টেডিয়ামের বাইরে এবং কয়েকটি রেস্টুরেন্টে একযোগে সন্ত্রাসী হামলায় ১৩০ জন নিহত হয়। এর পরই জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন ওঁলাদ। তবে এ ঘটনাকে একটি সন্ত্রাসী হামলা বর্ণনা করে কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের ঘরের ভেতর থাকার জন্য অনুরোধ করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে কে এই হামলাকারী? ফ্রান্সের গণমাধ্যমের বরাতে আজারবাইজানভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ট্রেন্ড-এর এক খবরে আইএসের দায় স্বীকারের কথা জানানো হয়েছে। তবে আইএস-এর ওই কথিত দায় স্বীকারের ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হামলাকারী মোহাম্মদ লাউয়েজ বাউলেল (৩১) নিসেরই বাসিন্দা। ফ্রান্সের পুলিশ তাকে আগে থেকেই চেনে। তিনি তিউনিশিয়ান বংশোদ্ভূত এবং তিউনিশিয়া ও ফ্রান্সের দ্বৈত নাগরিক। তার আইএস যোগের কথা পুলিশের জানা নেই। তবে পুলিশের কাছে তিনি নিস মতিন নামে পরিচিত।
এ ঘটনার পর ফ্রান্সের গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানিয়েছেন, ‘আমরা কয়েকটি গুলির শব্দও শুনতে পাই। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম যে, সেগুলো হয়তো আতশবাজির শব্দ। কিন্তু সবাইকে দৌড়ে পালাতে দেখে আমরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।
সামাজিক মাধ্যমে এ ঘটনার বেশ কয়েকটি ছবি প্রকাশ পেয়েছে। তাতে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষ আতঙ্কিত মুখে শহরের রাস্তা ধরে ছুটে পালাচ্ছে। আবার হতাহতদের অনেককে রাস্তায় পড়ে রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ফ্রান্সের ট্রাক হামলা : যখন বাস্তিল দিবস উদযাপন চলছিল, তখন আশপাশের হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্ট থেকে আতশবাজির ঝলকানি উপভোগ করছিলেন বিদেশি পর্যটকরাও। তবে বাস্তিল দিবস উদযাপনের সেই দৃশ্য যে মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহতায় রূপ নেবে তা হয়তো কল্পনাও করেনি কেউ। হামলার কবল থেকে শিশুদের বাঁচাতে নিরাপদে ছুড়ে দিচ্ছিলেন অভিভাবকরা। আতঙ্কিত মানুষের এদিক সেদিক ছুটোছুটি, গাড়ির নিচে চাপাপড়া মানুষের আর্তনাদ আর এখানে সেখানে মরদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রত্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেছেন সেই ভয়াবহতার কথা। তারা জানান, গাড়িটি যখন ভিড়ের দিকে এগিয়ে আসছিল তখন অনেকে কিছু না বুঝেই আতঙ্কিত হয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। শিশুদের বাঁচাতে মা-বাবারা তাদের বেড়ার ওপাশে ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছিলেন। ইসমালি খালিদির মতে, পুলিশ যখন ওই এলাকা থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলছিল তখন তা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছিল।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ছুটে আসা লোকজন বলছিল পুলিশ তাদের দৌড়াতে বলেছে তাই দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কেন দৌড়াতে বলেছে তা বলেনি। আর লোকজনও কারণ জানতে না চেয়েই জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ছুটেছে।’
বাস্তিল দিবস উদযাপনের সময় এ হামলার বিষয়ে খালিদি আরও জানান, অনেক বাবা-মা তাদের বাচ্চাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখলাম এক ব্যক্তি বেষ্টনীর ওপারে বাচ্চাকে ছুড়ে মারলেন এবং পড়ে নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন’।
নিস শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন মার্কিন-ফিলিস্তিনি লেখক ইসমালি খালিদি। ঘটনার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘আচমকা ভিড় থেকে মানুষকে ছুটে আসতে দেখলাম আমরা। কিছুক্ষণ পর আবার উল্টো পাশ থেকে ছত্রভঙ্গ মানুষ ছুটে আসতে দেখা গেল। আমি কখনও এ ধরনের বিশৃঙ্খল ও আতঙ্কের পরিস্থিতি দেখিনি। কিন্তু ঠিক কী ঘটছে তা কেউ বলতে পারছিল না’।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ছুটি কাটাতে ফ্রান্সের নিস শহরে আসেন টোনি মোলিনা। নিস শহরের একটি হোটেলে ওঠেন তিনি। আর ১৪ জুলাই বৃহস্পতিবার হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করে নিস শহরে ভয়াবহ ট্রাকহামলার ঘটনা। টোনি বলেন, ‘জানালা দিয়ে আমি দেখলাম ১০টি মৃতদেহ পড়ে আছে।’
ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১৫ ফুট দূরত্বে অবস্থান করছিলেন আরেক মার্কিন প্রত্যক্ষদর্শী। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘শুরুতে মনে হচ্ছিল এটি বোধহয় কোনো দুর্ঘটনা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এটি ইচ্ছাকৃত হামলা।’ সম্পাদনা : হাসান আরিফ