আছে-নাই’র আকাশ দেখার গল্প
‘নাই’ সাহেব ঠিক আমার পাশে বসে নেই। খানিকটা পিছে বসে আছে। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গেলে ঘাড়টা খানিকটা বাঁকা করে কথা বলতে হচ্ছে। সেটা আমার জন্য ঠিক যুৎসই হচ্ছে না। কাল রাতে বেকায়দায় ঘুমিয়েছি। ঘাড়ের রগে টান লেগেছে। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলা যাচ্ছে না। শরীর ও খানিকটা ঘুরিয়ে নিতে হচ্ছে কথা বলার সময়। ‘নাই’ প্রথমে আমার পাশাপাশিই বসে ছিল। ভাবছিলাম, ‘আছে’ এবং ‘নাই’ মিলে একটা সেলফি তুলবÑ ‘আছে-নাই আড্ডা’ নাম দিব সে ছবির। কিন্তু কখন যে ‘নাই’ কিছুটা পিছিয়ে বসেছে খেয়াল করিনি। অবশ্য মাথা চুলকাতে চুলকাতে, মুখের মধ্যে এক আঙুল ঢুকিয়ে নিজের ফোকলা দাঁতে বারবার হাত বুলাতে বুলাতে কখন যে সে পিছিয়ে বসেছে, সে নিজেও বোধহয় জানে না। সেলফি আর তুললাম না। একবার ভাবলাম তাকে বলি সামনে এসে বসতে। সেটাও আর বললাম না। থাক নিজের মতন করে ‘নাই’।
‘নাই’ গেল ঈদে কোম্পানিওয়ালাদের দেওয়া জামা পরে আছে আজকে। পকেটের কোণে কোম্পানির লোগো দেখা যাচ্ছে। শার্টের বোতাম টানাটানি বোধহয় ‘নাই’ এর প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে একটি। এই জামা খানিকটা ফতুয়া ধরনের, কিন্তু একটু ছোট্ট করে কলার আছে। ‘নাই’ সেই কলার ধরে টানাটানি শুরু করেছে, ঘাড় বাঁকা করে দেখলাম। কলারের এক কোণের সুতা বের হয়ে আছে। ‘বোতাম টানাটানি’ প্রতিযোগিতা হলে, চ্যাম্পিয়ন যে ‘নাই’ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি বলি, ‘কি রে দিনকাল কেমন যায়?’
‘যায়’ সে উত্তর দেয়।
‘করিস কি সারাদিন’Ñ আমি জিজ্ঞেস করি আবার
-‘কাজ’।
‘কি কাজ করিস?’
-‘ম্যালা কাজ’।
‘ওহ ভালো তো, তুই তো বিশাল কাজের মানুষ’
নাই উত্তর দেয় না, ঘাড় বাঁকা করে দেখি একটা লম্বা ঘাস ছিড়ে আমসত্বের মতন চুষে চুষে খাচ্ছে। আজকেও তার পা বালুতে মাখামাখি এবং আজকেও তাকে দেখে আমার মনে হলো, তার পা দুটো বুঝি বালু দিয়ে তৈরি।
আমি আবার সামনের দিকে ফিরে বসি। ঘাড় ব্যথা করছে।
‘বলতো আমি কি করি?’
-‘কাজ’ ঝটপট উত্তর দেয় ‘নাই’
‘কি কাজ’, পাল্টা প্রশ্ন করি
‘নাই’ উত্তর দেয় না। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না হয়তো।
‘কি বললি না তো, আমি কি কাজ করি’
-‘জানি না তো‘, উত্তর মেলে
‘তো বললি কেন কাজ করি?, আমি তো বসে আছি, বসে থাকা কি কাজ?’
-‘হ, সবকিছুই কাজ’
‘বাহ তুই তো বিশাল জ্ঞানী। আচ্ছা এই যেমন বেঁচে থাকাও তো একটা কাজ, তাই না রে?’
‘নাই’ উত্তর দেয় না। আমিও উত্তরের আশাও করি না।
বিকালের শেষ হওয়া আকাশে সন্ধ্যার দাপুটে আনাগোনা। আমি ‘নাই’ কে আবার প্রশ্ন করি, ‘তুই রং চিনিস? বলতো আকাশের রং কি?’
‘নাই’ চুপ। আমি ভাবলাম ‘উত্তর’ পাব না। কিন্তু ‘নাই’ উত্তর দেয়।
বলে, ‘আকাশের কোনো রং নেই, এইটারে বলে পাইনসা রং’
আমি উত্তর দিই না। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি ঘাড় না ঘুরিয়েও বুঝতে পারি ‘নাই’ও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আকাশের রং খুঁজতে থাকি। বালুর পাওয়ালা, ফোকলা দাঁতের ‘নাই’ যে কেন পানসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তা আমি জানি না। কিন্তু আমরা ‘আছে’ আর ‘নাই’ মিলে খুব মনোযোগ দিয়ে আকাশ দেখতে থাকি, কিংবা আকাশের রং খুঁজতে থাকি।
লেখক : কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন