আপনার সন্তানের মেলামেশা
জুলফিয়া ইসলাম
হয়তো লক্ষ্য করে দেখেছেন, ছোট্ট শিশুরা তাদের বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যেতে ভালোবাসে। তারা যখন বেড়াতে যায় তখন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে বন্ধুদের ঘরের সবকিছু দেখে। নতুন কোনো খেলনা দেখলে তা ধরে দেখে। তার বন্ধুরা কি রকম পেন্সিল দিয়ে লিখে, কোন ধরনের পুতুল দিয়ে খেলে, অর্থাৎ অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন তুলনা করে দেখে। তুলনা করার পর কিছু কিছু জিনিস সে মেনে নেয় কিছু কিছু জিনিস সে মানতে পারে না।
আমাদের মাথার ওপরে রয়েছে দিগন্তজোড়া আকাশ। নির্মল বায়ু এবং সূর্যতাপ আমরা উপভোগ করছি। চারপাশে অসংখ্য মানুষ রয়েছে যারা আমাদের অচেনা। এই বোধগুলো জন্মের পরে প্রতিটি মানুষই অনুভব করে থাকে। বিশেষত পৃথিবীকে জানার অদম্য কৌতূহলে শিশু চারপাশের লোকজনের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। নিজের কাছ থেকে অন্যের কাছে যাওয়া। একাকীত্ব ছেড়ে সঙ্গ লাভ করা। এ এক অমূল্য প্রাপ্তি। ধীরে ধীরে শিশুরা আশেপাশের লোকজনকে বুঝতে শিখবে। কথাবার্তা বলতে ও সংবাদ আদান-প্রদান করতে শিখবে। এভাবে ছোট্ট শিশুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত হবে।
শিশুরা কখনও একা থাকতে ভালোবাসে না। মানবিক মেলামেশার গুরুত্ব যে কতখানি এটি তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শিখে। শিশুদের জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি পুরোপুরিই বড়দের ওপর নির্ভর করে। শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব প্রবলভাবে দেখা যায়। তারা কোনো কাজেই অন্যের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে চায় না। তারা একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করে পরস্পর পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করে। এই মেলামেশা থেকে তারা অনেক কিছু শিখে থাকে। অথচ বেশির ভাগ সময় আমরা মনে করে থাকি, আমরা আমাদের সন্তানদের সবকিছু শিখিয়ে থাকি। আমাদের এ ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। শিশুরা তাদের সঙ্গী-সাথীদের পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শিখে থাকে।
সমবয়সী থেকে যে শিশু বঞ্চিত হয় সে অনেক কিছু শিখতে পারে না। এতে তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়। নিজের সন্তানকে ভালোভাবে জানতে পারব যদি সে আরও অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মাঝে থাকে। অনেক শিশুর মাঝে যখন সে থাকে তখন আমরা বুঝতে পারব তার আচরণের মধ্যে কি কি অভাব রয়েছে। কারণ, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের একা কোনো বিষয় তুলনা করতে পারি না। সন্তানদের সব সময় মুখ দেখে আমাদের অভ্যস্ত। তাদের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ আমাদের নখদর্পনে। অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যদি তারা না মেশে তবে তাদের আচার-আচরণের পার্থক্য আমরা তাদের সামনে তুলে ধরতে পারব না।
ছেলেমেয়েরা যখন একসঙ্গে খেলে তখন দেখা যায়, তাদের আচার-আচরণের মাঝে কতটুকু ভিন্নতা রয়েছে। কোনো ছেলে দেখা যাবে অত্যন্ত রাগী, কেউ চালাক আবার কেউ অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। কেউ কেউ দেখা যায়, অন্যের জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশি। আবার কেউ কেউ অত্যন্ত উদার প্রকৃতির হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা যদি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাবো, খেলার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ, আচার-আচরণ এবং চরিত্র গঠন।
এক কথায় খেলার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সহনশীলতা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, নিপুণতা ইত্যাদি গড়ে ওঠে। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীরা খেলার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতা, বৈরিতা, সহানুভূতি, স্বার্থপরতা ইত্যাদি অভিজ্ঞতা লাভ করতে সক্ষম হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও মনোবিশ্লেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন