সুই বা রকেট বানানো সম্ভব, সুন্দরবন নয়
আলমগীর স্বপন
‘সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে চলাচলকারী কয়লা, ছাই, সার ও তেলবাহী একেকটি জাহাজ বাঘের জন্য ভ্রাম্যমাণ বোমা।’ গত ১৫ এপ্রিল ভারতের বন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনের বাঘের অবস্থা’ শীর্ষক এক জরিপে একথা বলা হয়েছে। জরিপের প্রধান সমন্বয়কারী এবং ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার অধ্যাপক রাজভেন্দর ঝালা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে যেসব জাহাজ চলাচল করছে, তাতে বাঘের একপাড় থেকে অন্যপাড়ে যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল বাড়বে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কার পাশাপাশি বাঘের চলাচলে আরও বাধার সৃষ্টি করবে।’ (সূত্র : প্রথম আলো)
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন-সুন্দরবনে কি প্রভাব পড়বে তার একটি দিক এটি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এমন সংকট অর্থাৎ যার জন্য আমরা চুরি করছি, তারাই বলছে চোর? আর এর সূদুরপ্রসারী প্রভাব কি, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবন, গবেষণার মাধ্যমে তা দীর্ঘদিন ধরে দেখিয়ে আসছেন আমাদের পরিবেশবাদী, উন্নয়নকর্মী, বিশেষজ্ঞরা। এরপরও গত মঙ্গলবার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি সই হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার অটল। সরকার বলছে, উন্নয়নের সড়কে থাকতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এটা কেউ অস্বীকার করছে না। বিএনপি আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বক্ষমতা ছিল মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার। অভিযোগ আছে, বিগত বিএনপি সরকার ৫ বছরে মাত্র ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে। সর্বশেষ ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যকে সাধুবাদ দিতে কারও কার্পণ্য নেই। কিন্তু উন্নয়নের প্রকৃত লক্ষ্য যদি মানুষের সক্ষমতা এবং সক্ষমতার প্রসার হয়, এর মধ্যে থাকতে হয় পরিবেশ প্রতিবেশ ভাবনাও। সেক্ষেত্রে সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার বিকল্প কি ছিল না? ভারত যখন তার অংশের সুন্দরবনের গুরুত্ব বুঝছে তখন আমরা কোন মোহে শত্রুতায় নেমেছি আমাদের প্রাণ সুন্দরবনের বিরুদ্ধে। এর মাধ্যমে আসলে কার বা কিসের উন্নয়ন চাই আমরা?
এক্ষেত্রে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও গবেষক জঁ দ্রেজের স্মরণাপন্ন হওয়া যাক। যৌথ প্রকাশনা ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ বইয়ে তারা বলছেন, ‘ভারতের উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্র জেলায় গোবিন্দবল্লভ পন্থসাগর নামক এক কৃত্রিম জলাশয়ের ধারে ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) একটি বিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। আমাদের মধ্যে একজন এনটিপিসির মূল অফিসে গিয়েছিলাম। অফিসটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছেই, চমৎকার সবুজ একটি ক্যাম্পাসের মধ্যে। তখন গ্রীষ্মকাল। গিয়ে দেখা গেল, গেস্ট হাউসের লবি খাঁ খাঁ করছে, কিন্তু সেখানে এয়ার কন্ডিশনারটি চলছে পুরোদমে। ক্যাম্পাসের সীমানার ঠিক বাইরেই শ্রমিকদের বস্তি, গত পঁচিশ বছর ধরে তারা ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করছেন। তাদের বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, যেমন নেই অন্য কোনো আধুনিক পরিসেবাও। তাদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তারা বলেন, দুরবস্থা নিয়ে অভিযোগ জানালে তাদের কাজ চলে যেতে পারে, সেই ভয়ে তারা কিছু বলেন না। একটু দূরেই বসবাস করেন আরও কিছু মানুষ, তাদের বসতি উচ্ছেদ করেই এককালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। তাদের হালও ওই বস্তিবাসীদের মতোই এবং তারাও ভয়ে কিছু বলেন না।’
ভয় আমাদেরও আছে। তাই আমরাও বলছি, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সেখানে নিশ্চয়ই সুখে শান্তিতেই থাকবেন ভূমিপূত্র-শ্রমিকরা? উত্তর প্রদেশের শোনভদ্রের মতো অমঙ্গলের পাকে পড়বে না রামপালের মানুষ? কেননা সরকার সবকিছুই করছে দেশের মঙ্গল ও উন্নয়নের চিন্তায়? ‘সুই বা রকেট বানোনো সম্ভব, সুন্দরবন নয়’Ñ একথা কি শুধু আমরাই বুঝি, সরকার বোঝে না?
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন