দেশে ছোট বড় ২৪টি জঙ্গি সংগঠন তৎপর জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন জিয়ার শাসনামলে
প্রথম হামলার ঘটনা উদীচীর অনুষ্ঠানে
আজাদ হোসেন সুমন : দেশে ছোট বড় ২৪টি জঙ্গি সংগঠন তৎপর আছে। এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর গোড়াপত্তন হয় ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এবং প্রথম হামলার ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে তৎপরতা চালাচ্ছে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দেশে জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। এ বিষয়ে সুইডেনের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক বারটিন লিন্টনার ১৯৯১ সালে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা যুদ্ধে অংশ নিতে দেশ থেকে অনেক বাংলাদেশি মুজাহিদিন আফগানিস্তানে গিয়েছিল। সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে এরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণে পারদর্শী হয়ে উঠে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হলে এসব মুজাহিদিন দেশে ফিরে আসে এবং বাংলাদেশে একটি শরিয়াভিত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়ে উঠে। আল্লাহর আইন ও কুরানের শাসনের ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেøাগান দিয়ে তারা সংগঠিত হতে থাকে। মুজাহিদিন নামধারী জঙ্গিরা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলাম, আফগানিস্তানের গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হিজবি-ই-ইসলাম, কাশ্মীরের হিজবুল-মুজাহিদিনসহ বহু জঙ্গি সংগঠন থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা পেয়ে দেশের নানা অঞ্চলে সংগঠিত হয়।
সূত্রে জানা যায়, ১৯৮১ সাল থেকে ৯০ পর্যন্ত এরশাদের স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো যখন পিষ্ঠ হচ্ছিল তখন ইসলামের দোহাই দিয়ে কুরান হাদিসের বিভিন্ন আয়াতের অপব্যাখ্যা করে জঙ্গি নেতারা দেশব্যাপী নিজেদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। ৯০’র গণঅভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যে হতে ব্যর্থতার কারণে আরও সক্রিয় হতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা ও দলের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারি আচরণে বিষয়টিকে জঙ্গিরা সুযোগ হিসাবে কাজে লাগায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে হিজবুত তাহরির, আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ নামে জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বড় ধরনের জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে যশোর টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সম্মেলনে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ রাতের ওই ভয়াবহ বোমা হামলায় প্রাণ যায় ১০ জনের এবং আহত হয় প্রায় দু’শ নারী-পুরুষ। এ হামলার পর দেশে আলোচনায় উঠে আসে জঙ্গিবাদের বিষয়টি।
সূত্র আরও জানায়, জঙ্গিদের এ তৎপরতা বন্ধে আল হিকমা, হরকাতুল জেহাদ ও হিজবুত তাহরিরসহ বেশক’টি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে ২০০০ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু তার পরও জঙ্গিবাদ থেমে থাকেনি। তারা সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপরিণাম দর্শিতা, দৈন্যতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার নীতি প্রকারান্তরে জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়।
বর্তমানে দেশে জেএমবি, আনসারুল্লা বাংলাটিম, হিজবুত তাহরির, হরকাতুল জেহাদ, জাগ্রত মুসলিম জনতাসহ ছোট বড় ২৪টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই একাধিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালনা, বোমব্লাস্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গিরা বাংলাদেশে নাশকতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। এসব সংগঠন উল্লেখিত দেশগুলো ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের কমপক্ষে ১০টি দেশ ও অর্ধশত এনজিও থেকে অর্থ সহায়তা পেয়ে থাকে বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন গতকাল দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা দূরোহ ব্যাপার। এরা একদিনে সংঘবদ্ধ হয়নি। এদের শেকড় এখন অনেক গভীরে গেঁথে গেছে। আশার আলো দেখতে পেতাম যদি আওয়ামী লীগ বিএনপি এবিষয়ে একমত হতো। এ দুটো বড় রাজনৈতিক দল এক হলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠতো। কিন্তু সেটাও হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ আওয়ামী লীগ দিন বললে বিএনপি বলে রাত। এদুটো রাজনৈতিক দল একে অপরের শত্রুমনোভাবাপন্ন-যা নাকি দেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। জঙ্গিবাদ নির্মূলে জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বলছে তাদের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য হবে আর বিএনপি বলছে উল্টোটা। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে শর্ত দিচ্ছে জামায়াত ছাড়তে আর বিএনপি শর্ত দিচ্ছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে। এ অবস্থায় জাতীয় ঐকমত্য হবে বলে আমার মনে হয় না। তবু আমরা আশাবাদী, মানুষ আমরা স্বপ্ন দেখি আশা নিয়ে বেঁচে থাকি। আমার প্রত্যাশা সব মতভেদ ভুলে এ দুই রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষুদ্রস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছবে এবং দেশ থেকে একদিন জঙ্গিবাদ চিরতরে নির্মূল হবে। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম