আমি হুমায়ূন আহমেদ হতে চেয়েছিলাম
যে বয়সে ছেলেপেলেরা সুপার ম্যান কিংবা ফেলুদা হতে চায়, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সে ‘হুমায়ূন আহমেদ’ হতে চেয়েছিলাম। আমার গোটা জীবন ব্যর্থ হওয়ার নেপথ্য কারণ এটাই। এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে, এক রাষ্ট্রে দুই নেত্রী বাস করতে পারেন কিন্তু এক দেশে দুই হুমায়ূন আহমেদ সম্ভব না। আমার প্রথম উপন্যাস বেরিয়েছিল ’৯৫ সালের বইমেলায়। আহা কত কষ্টের সেই বই। একটা নাম না জানা প্রকাশনী থেকে। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। এক রঙা প্রচ্ছদে। সেই একই বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাস বের হলো। ব্যস, আমার বইয়ের স্টলে সব কয়টি কপি অবিক্রিত রয়ে গেল, আর আমি বানের তোড়ে ভেসে গেলাম। আমার সকল শ্রম, মেধা, রাত জেগে লেখা বইয়ের পোস্টার, নটরডেম কলেজের সিন্ডিকেট আর আইডিয়াল স্কুলের বন্ধুদের তাবৎ ফিল্ডওয়ার্ক ব্যর্থ করে দিয়ে, রবিকে পেছনে ফেলে ‘কবি’ এগিয়ে এলো। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। লোকজন পিলপিল করে মেলায় ঢুকছে আর হলুদ রঙের ‘কবি’ উপন্যাস নিয়ে বেরিয়ে আসছে। ঝাঁকে, ঝাঁকে। একজন তরুণ লেখক হিসেবে প্রথম উপন্যাস বের করে বুঝে গেলাম, হুমায়ূন আহমেদ থাকতে বাংলা সাহিত্যে বই বিক্রি করে অন্য কেউ লেখক হতে পারবে না। অন্যত্র, অন্যভাবে লেখক হওয়া সম্ভব। সাহিত্যসভায় কালজয়ী সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব, কবি সম্মেলনে নিভৃতিচারী কবি হওয়া সম্ভব, সাহিত্যপত্রিকার জীবনঘনিষ্ট লেখক হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু পাঠকের হুমায়ূন আহমেদ, বইমেলার হুমায়ূন আহমেদ হওয়া সম্ভব নয়। এটিই তিতকুটে সত্য, নির্জলা বাস্তবতা । আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম আমার ‘হুমায়ূন আহমেদ’ হওয়ার স্বপ্ন কিভাবে লুট করে নিয়ে গেলেন আদি ও অকৃত্রিম আসল হুমায়ূন আহমেদ স্বয়ং। এ বেদনা ভোলার নয়। এক কপি ‘কবি’ উপন্যাস হাতে নিয়ে আমার প্রকাশক বন্ধু খালেদ সেদিন বলেছিল, আহা, কবি রবিকে মেরে দিয়েছে।
কবি কেবল আমাকে একা মারেনি, প্রকাশক খালেদকেও মেরেছিল। ‘কবি’ মেরেছিল আরও অনেককেই। অধিকাংশই স্বীকার করেন না, করবেনও না। কিন্তু আমি বুদ্ধিমান না হলেও বোকা নই। কাজেই লিখতে হবে, লিখে যাব। কিন্তু বই বিক্রি? স্যার থাকতে? অসম্ভব। লেখক হিসেবে আমাকে অন্য পাড়ায় গিয়ে মাস্তানি করতে হবে, হুমায়ূন আহমেদ থাকতে এ পাড়ায় মাস্তানির কথা চিন্তাও করা চলবে না দাদা, সে আমি বুঝে গিয়েছিলুম ঢের আগে, সেই ’৯৫ সালেই।
সাংবাদিকতার সূত্রে অনেক কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিকের সঙ্গে মৃদু ঘনিষ্টতা হয়েছে আমার। আমি এমন কোনো মাছ দেখিনি, যেটি পানি ছাড়া সাঁতার কাটে। এমন কোনো বঙ্গীয় সাহিত্যিক দেখিনি যিনি হুমায়ূন আহমেদকে গালি না দিয়ে জলস্পর্শ করেন কিংবা জলস্পর্শ শেষে হুমায়ূন আহমেদকে ঝেড়ে গালাগাল করেন না। সস্তা লেখক, চটুল সাহিত্য, মেয়ে ভোলানো লেখা, আরও কত কিছুই যে শুনেছি এবং শুনে আসছি হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে। হুমায়ূনকে গালাগালি না করারও কোনো সঙ্গত কারণ নেই। এক বইমেলার বই বিক্রির হিসাব পত্রিকায় পড়েছিলাম। সর্বমোট ছয় কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। কেবল হুমায়ূন আহমেদের বই বিক্রি হয়েছে সোয়া চার কোটি টাকার। আর বাদবাকি টাকা অন্যসব লেখক মিলে।
লেখার এই জায়গায় এসে কেউ কেউ টং করে বলে উঠবেন, বই বিক্রিই কি জীবনের শেষ কথা? বই বিক্রি জীবনের শেষ কিংবা প্রথম কথা নয়। তবে একজন লেখকের জন্য বই বিক্রি মানে হচ্ছে, অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছানো। মধ্যবিত্তের ড্রইংরুম থেকে দামী শোপিস চুরি হয় না, কেবল হুমায়ূন আহমেদের বই খোয়া যায়। আমি নিজেই তো হুমায়ূন আহমেদের কত বই কিনেছি। কই সব বই তো আমার সেলফে নেই! বরং আমার টেবিলে হুমায়ূন আহমেদের ‘কুটু মিয়া’ উপন্যাসটি আছে। সে বইয়ের প্রথম পাতায় লেখাÑ মুনমুনের জন্মদিনে হাবিবের উপহার। কে এই মুনমুন, কেইবা এই হাবিব, আমি এদের চিনি না। কিন্তু হাবিব- মুনমুন একত্রে আমার টেবিলে যে শুয়ে আছেÑ এজন্য আমি একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কাউকে দায়ী করব না।
লেখক : উপস্থাপক ও সাংবাদিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন