এই মহা বিপদের দিনেও দেশটাকে ভাঙা কাঁঠাল মনে করেন যারা!
মাসুদা ভাট্টি
ক্ষমতাসীন সরকার এই বিশাল জমায়েতকে নিজেদের পক্ষে ভেবে নিরপেক্ষতার ভান করে রইল আর উল্টো দিকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রকাশ্যেই এদেরকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে বসলেন। তার এই আখ্যার পরপরই তারই বশংবদ এক পত্রিকায় ব্লগারদের লেখা ব্যক্তিগত ব্লগ থেকে অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ করা শুরু করে দিলেন।
শুরু হলো দেশে নতুনতর বিভাজন। আর এই বিভাজনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি পালন করল দেশের মিডিয়া। ব্যালেন্সের নামে যাদেরকে হাজির করা হলো ‘টক শো’য়ে বা যে সব খবরাদি প্রকাশ করা হলো তাতে তথাকথিত ‘নাস্তিকদের’ বিপক্ষে জনমত জোরালো হওয়া শুরু হলো। এবং ঠিক সেই সময়ই হেফাজত নামে একটি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনকে ঢাকায় হাজির করার মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো, শাহবাগের জমায়েতের বিরুদ্ধে হেফাজতের ৫ মের জমায়েতই আসলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার টানাপোড়েনের প্রকৃত চেহারা। কিন্তু কেউই একথা জোর করে বলার মতো সাহস পেল না যে, হেফাজত নামে যাদেরকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় আনা হলো তারা গণতন্ত্র বোঝে না, তারা বোঝে আল্লাহ্র শাসন, সুতরাং যারা তাদেরকে এনেছে তারা তাদেরকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকায় এনেছিলেন। তাদের মাথায় দেশটাকে কাঁঠালের মতো রেখে এরাই আসলে এক সময় সে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার পায়তারা করছিলেন। যেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশে একটি রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও সামাজিক ঐক্য হওয়ার কথা ছিল, গণজাগরণ মঞ্চ যার মূল কেন্দ্র হতে পারত, তা না হয়ে এই তরুণ সমাজকে কেন্দ্র করেই দেশে বিভাজনটি আরও পোক্ত করা হলো। এবং এখানে স্বীকার করতে কারোরই অসুবিধা থাকার কথা নয়, এই বিভাজনের খেলাটি আবারও কিন্তু খেললেন জিয়াউর রহমানের মতোই তার স্ত্রী বেগম জিয়া এবং জেনারেল জিয়ার মতোই খেলাটি সম্পন্ন হলো জামায়াতকে দিয়ে।
২০১২ থেকে শুরু করে দেশে যে বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়েছিল, তাতে আর কোনো দেশ হলে এতদিন সত্যিই ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু যেহেতু বাঙালির ধংসস্তুপের ওপর ফুল ফোঁটানোর ইতিহাস অতি প্রাচীন, সেহেতু বাঙালি ঢিট হয়ে দেশটাকে টিকিয়েই রাখল না কেবল, এরই মধ্যে প্রায় অসাধ্য সাধন করে দেখাল। অর্থনৈতিক সূচকে যেমন অগ্রগতি এলো তেমনই দেখা গেল, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও সরকার নজির সৃষ্টি করতে সমর্থ হলো। ঠিক এই সময় দেশের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীর কেউ কেউ যোগ দিল। প্রতিশ্রুত সহযোগিতা চুক্তি বাতিল হলো তুচ্ছ ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে। মনে রাখতে হবে, কোনোরকম ঘুষ লেনদেনের তথ্য তাদের হাতে ছিল না, তাদের দেওয়া তথ্যমতে তাদের কাছে কেবল তথ্য ছিল, পদ্মা সেতুতে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ লেনদেন হতে পারে। ঋণদাতা সংস্থাটির এলোমেলো বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হলো, ঘাপলা আসলে তাদের মধ্যেই। ঠিক এই সময় অন্য কোনো দেশ হলে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতো পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। দলমত নির্বিশেষে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার জন্য তাগিদ ওঠার কথা ছিল কিন্তু কার্যত দেখা গেল, এই তাগিদ কেবল ছিল শেখ হাসিনা ও তার দলের মধ্যে। আর কেউ এই তাগিদ ঠিক অনুভব করেছেন বলে বোধ হলো না। সকলেই শেখ হাসিনার ওপর দোষ চাপিয়ে বিশ^ব্যাংককে বিশ^াস করার পথ ধরলেন। শেখ হাসিনা গোঁয়াড়ের ভূমিকা নিয়ে দাঁত কামড়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিলেন এবং এখনও সেই ঘোষণার ওপরই দাঁড়িয়ে আছেন পদ্মা সেতুর কাজ পুরোদমে এখন চলছে। এই পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন নিয়ে দেশের ভিতর কোনো গবেষণা হয়েছে কি হয়নি তা জানা না গেলেও, লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ের বার্বেক কলেজে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড ফাইন্যান্স ল’ বিষয়ে প্রায় এক সপ্তাহের ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছে পদ্মা সেতু ও তাকে কেন্দ্র করে সরকার ও ঋণদাতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভিতরে টানাপোড়েন বিষয়ে। এখানে মূলত, আলোচ্য প্রতিষ্ঠান তথা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর খামখেয়ালি নিয়েই আলোচনা বেশি হয়েছে বলে জানা যায় এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো যার শিকার।
আবারও বলতেই হচ্ছে, দেশের জন্য গভীর প্রয়োজন দেখা দেয় তখন জাতীয় তাগিদে ঐক্য বা একযোগে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনায়ও আমরা দেখতে পাই, দেশকে খুব দ্রুত রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে ফেলা হয়। যেমনটি আবারও দেখা যাচ্ছে এখন, যখন জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ দানবের হাতে আক্রান্ত দেশ, মানুষ ও মানবতা। এখনও একটি পক্ষ প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন মদদ দিয়ে যাচ্ছে এই চাপাতিবাজ, বোমাবাজ ও বন্দুকবাজ আতঙ্কবাদীদের। দেশের ভিতর থেকেই সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে তাদেরকে ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন আইএস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার, বিদেশ থেকে এই চাপ আরও আগে থেকেই আসছিল। কিন্তু ঠিক কেন সরকারকেই একথা স্বীকার করতে হবে আর স্বীকার করলে ঠিক কী হবে তা কেউই স্পষ্ট করে বলছেন না। গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর আবারও আলাপ শোনা যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যের। শীতনিদ্রা থেকে বেরিয়ে আসছেন বয়োবৃদ্ধ সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। তারা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এই জঙ্গিবাদের উত্থানের পক্ষে। কিন্তু এর গোড়ায় কেউ যাচ্ছেন না, সকলেই যেন ভুলে বসে আছেন, ‘ওরা শাহবাগী ওরা নাস্তিক, ওরা নষ্ট ছেলে’ বলে ট্যাগ করে আজকের জঙ্গিবাদকে উস্কে দেওয়ার সেই শুরুর দিককার ঘটনায়। সকলেই কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে যাচ্ছেন। অবশ্য সকলেই একথা একটু হলেও স্বীকার করছেন, এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান একটু হলেও খাঁটো হয়েছে আর সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ হারাতে বসেছে তার অবস্থানটিও। জানি না, এই অপূরণীয় ক্ষতি বাংলাদেশ কী করে কাটিয়ে উঠবে। বিশেষ করে, এর ফলে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অগ্রগতির সিঁড়িতে পা রেখেছিল তা থেকে যে পিছলে পড়ল সে খেয়াল হয়তো আমাদের কারোরই নেই। কারণ আমরা যেন বুঝতেই চাইছি না, একই সঙ্গে সামনে ও পেছনে হাঁটা যায় না, হয় সামনের দিকে এগুতে হয়, নয় পেছনের দিকে পেছাতে হয়। আসলে যারা দেশটাকে ভাঙা কাঁঠাল মনে করেন, তাদের পক্ষে এই সত্য উপলব্ধি সম্ভবও যে নয়, সেকথা বলাই বাহুল্য।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন