সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৬ ধর্মগুরু সদস্য হত্যার তদন্তে স্থবিরতা
দীপক চৌধুরী : ‘অপ্রতিরোধ্য’ জঙ্গি তৎপরতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তা বাড়লেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু ও মঠের সেবায়েত হত্যার তদন্তে ভাটা পড়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো হত্যাকা-ের খুনি ও জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জানেনও না এসব হত্যার আদৌ তদন্ত এগোবে কি-না। গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এখন সবচেয়ে বেশি তৎপর। ফলে পুলিশ ব্যস্ত এখন অন্যান্য নিরাপত্তার কাজে।
সারাদেশেই সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-আতঙ্ক এখন বেশি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন সক্রিয়তা বাড়াচ্ছিল সাময়িকভাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, র্যাব হেডকোয়ার্টার্স পৃথক বৈঠক করেছে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ইস্যুতে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর গুলশানে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মহল থেকে নিখোঁজ তরুণের খোঁজ নিতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। নিখোঁজ এসব তরুণের খোঁজে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা এখন মরিয়া। তারা চায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িত অপরাধীদের ধরতে।
গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যা প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকে ইঙ্গিত করেছিলেন। ‘আমার কাছে এসব গুপ্তহত্যার তথ্য আছে’Ñ প্রধানমন্ত্রী একথা বলার পর প্রায় প্রতিটি বৈঠকে সন্দেহযুক্ত জেলায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বাড়াতে জেলার পুলিশ সুপারদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলার পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকদের সারাক্ষণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর হত্যাকারীদের গ্রেফতারে আগের মতো এখন তৎপর নয় পুলিশ।
পাবনায় অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-েকে পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়। ঘাড়ে ও মাথায় এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে দেখে মনে হয় খুনিরা তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিল।
জুন মাসে ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী, নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ ও পাবনায় খুন হন নিত্যরঞ্জন। কিন্তু ঘাতকরা গ্রেফতার হয়নি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এ প্রতিবেদককে বলেন, সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনিসহ তিনজন মন্ত্রী ঝিনাইদহে গিয়েছিলেন। নৃশংসভাবে গুপ্তহত্যার শিকার পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর বাড়িতেও যান তারা। তিনিসহ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গিয়েছিলেন জানিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, হত্যাকারীদের গ্রেফতারে ‘কোনো রকম ছাড় দেবে না সরকার’। আশ্বাসও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
৩০ জুন ঝিনাইদহ সদরে শ্রীশ্রী রাধামদন গোপাল মঠের সেবায়েত গোঁসাই শ্যামানন্দ দাস ওরফে বাবাজিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ভোর সকালে শহরের দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে করে আসা তিন ব্যক্তি শ্যামানন্দকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় কুপিয়ে চলে যায়।
গত ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের মহিষারভাগাড় এলাকায় আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এসব আলোচিত হত্যা ঘটনার তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
নিহত শ্যামানন্দের বড় ভাই বিশ্বনাথ সরকার বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ধর্মযাজকদের হত্যা করা হচ্ছে। আগের হত্যাগুলোর বিচার হলে ঘটনার পুনরাবৃৃত্তি ঘটত না। এসব হত্যাকা-ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ঘাতকদের শনাক্ত বা গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্তে ভাটা পড়েছে।
খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান মনে করেন, সব হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা। তাই জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছেন তিনি। তিনি বলেন, এগুলো টার্গেট কিলিং বলা যেতে পারে। আমরা তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হব এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা বদ্ধপরিকর। তদন্তে কোনো ঢিলেমি নেই।
বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্মমহাসচিব দীপক পিরিছ বলেন, সারাদেশেই এখন আতঙ্ক। খ্রিস্টান সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের স্থানীয় প্রশাসন গ্রেফতার করতে পারেনি। সংখ্যালঘু হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব কথা বলছেন, যেভাবে আমাদের আশ্বস্ত করছেন তা কিন্তু খ্রিস্টান পরিবারের ঘরে ঘরে পৌঁছায় না। তিনি বলেন, সুনীল গোমেজ হত্যার আগেও বনপাড়ায় গাব্রিয়েল কস্তা ও বীণা পিরিছকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার অপচেষ্টা চালানো হয় গত ২৭ জানুয়ারি। কিন্তু এ নির্মম ঘটনাকে ডাকাতি ‘আখ্যায়িত’ করে অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। হামলাকারীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হয়নি। দীপক পিরিছ বলেন, আমরা ঢাকা প্রেসক্লাব, বনপাড়া ঘটনাস্থল এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন ও সমাবেশ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিÑ তাতে মনে হচ্ছে এদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষরা কোনোভাবেই আতঙ্কমুক্ত হচ্ছেন না। সন্ত্রাসী ঘাতকদের গ্রেফতার ও উপযুক্ত বিচার দরকার।