অবশেষে আইএস খুঁজছে বাংলাদেশ
এল্যান ব্যারি ও মাহের সাত্তার : বাংলাদেশ এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশটিতে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া সন্ত্রাসী কর্মকা-কে ঘিরে। এখন অনুসন্ধান করছে সেসব সন্দেহভাজনদের যারা দেশটিতে ইসলামিক স্টেটকে অস্তিত্বশীল করে তুলেছে এবং যারা সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধ করতে বাংলাদেশি তরুণদের সংগ্রহ করছে।
বাংলাদেশ সরকার বলছিল যে দেশটিতে পরিচালিত সন্ত্রাসী কর্মকা- করেছে দেশেরই কিছু সন্ত্রাসী এবং তাদের মদতদাতারাও দেশি। আল কায়েদা বা আইএস সন্ত্রাসী ঘটনার দায় স্বীকার করলেও দেশটি সে দাবি সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে, সম্প্রতি ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার পর ১০ জন ভয়ঙ্কর সন্দেহভাজনের তালিকা প্রকাশ করে। আর এ তালিকা সরকারের দাবির বিপক্ষে কথা বলে।
এই তালিকায় রয়েছে তিন জন প্রবাসী বাংলাদেশি। তারা দীর্ঘদিন ধরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে বসবাস করছেন। তাদের পুলিশ খুঁজছে দীর্ঘদিন ধরে। সন্দেহ করা হচ্ছে তারাই ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যোদ্ধা সংগ্রহ করে এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এই তালিকার চতুর্থ জন গতবছর থেকে লাপাত্তা। সে তার ভাইকে জানিয়েছে আইএস-এর পক্ষে লড়াই করতে তার অবস্থান এখন ইরাকে। এ তথ্য পুলিশ জানিয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত সন্দেহভাজন তামিম আহমেদ চৌধুরি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বাংলাদেশে আইএস কর্মকা-ের সমন্বয়কারী তামিম। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলের দায়িত্বেও তামিম। পুলিশ জানিয়েছে, কোনো সন্দেহভাজনই আটক হয়নি। কারণ তাদের কেউ কেউ উচ্চমাত্রার আইনি সুরক্ষা নিয়ে দেশে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করছে। আর অন্যরা লাপাত্তা।
এসব সন্দেহভাজনদের পরিচয় থেকে একথাই জানা যায় যে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে আন্তর্জাতিক ও দেশি সন্ত্রাসীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে।
ইলিনয়স স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতির অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সম্ভবত আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে কৌশলগত পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ এই তিন জনের বাইরেও কি কোনো সমন্বয়ক আছে, যাদের আমরা চিনি না।
গত শরতের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কর্মকর্তারা খোলামেলাভাবেই বলতেন, ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যারা যোদ্ধা সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশি তরুণদের প্রলুব্ধ করতে চেয়েছে তারা ততটা সফল হয়নি। কর্মকর্তারা এটাকে বাংলাদেশের জন্য জরুরি সমস্যা হিসেবে দেখেনি। আইএস-এ যোগ দেওয়া তরুণদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ধারণা করা হয় কয়েক ডজন হবে। কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল এসব তরুণ দেশের ভেতর কোনো হামলা চালাতে আগ্রহী নয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ইসলামিক স্টেট সমর্থকদের ব্যাপারে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য আছে। তিনি একথা বলেছিলেন গত বছর দেওয়া এক সাক্ষাতকারে। তিনি আরও বলেছিলেন, তাদের দৃঢ় ধারণা ওসব সমর্থকরা সিরিয়ায় গিয়ে জিহাদে অংশ নিতে চায়। বাংলাদেশে কিছু করতে চায় না। তারা বাংলাদেশে কাউকে খুন করবেÑ এটা তাদের পরিকল্পনায় নেই।
এর পর, বাংলাদেশে সংগঠিত হামলার সঙ্গে আইএস জড়িত কি-না, এ প্রশ্নটিই বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়। এ সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছিল আঁড়িপেতে পাওয়া কিছু যোগাযোগ-এর ওপর ভিত্তি করে। তখন বলা হয়েছিল, আইএস বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর কদিন পরই দুজন বিদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর দায় স্বীকার করতে থাকে আইএস।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সংশয়ী ও অবিশ্বাস নিয়ে সাড়া দেন। অভিযোগ করেন যুক্তরাষ্ট্র ঢাকার সঙ্গে কোনো কার্যকর গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইএসযুক্ত থাকার কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও ইসলামিক স্টেট যুক্ত থাকার বিষয়টি সম্পর্কে তেমন প্রমাণ মেলেনি। তদন্তকারীরা অতীতের কয়েক ডজন হামলা চিহ্নিত করেছে, যা শক্তিশালী স্থানীয় গ্রুপের কাজ। এসব গ্রপের অনেকগুলোই কয়েক দশক ধরে ক্রিয়াশীল।
হামলার দায় আইএসআইএসকে দেওয়ার ফলে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাকশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। কেননা, এ খাতের অনেক বিদেশি ক্রেতা কম করে হলেও একবার দেশটি সফর করে।
এ মাসে ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে জঙ্গিরা ২২ জনকে খুন করে। এর পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটা স্থানীয় জঙ্গিদের কাজ। আর এটা করেছে জামাতুল মুজাহিদিন নামের একটি সংগঠন। যদিও জঙ্গিরা ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যুক্ত একটি ই-মেইল একাউন্ট ব্যবহার করে ছবি পাঠিয়েছে।
তদন্ত এগোতে থাকলে কর্মকর্তারা তাদের অবস্থান বদল করে। তারা মনে করতে থাকেন জঙ্গিদের সঙ্গে হয়তো আইএস যোগসূত্র থাকতে পারে। এখন পুলিশ বেশকিছু সন্দেহভাজনকে খুঁজছে, যারা স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ের কাজ করছে। ১০ সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকা শীর্ষ তিনজনের একজন মিস্টার ইসলাম। তাকে গত বছর ইসলামিক স্টেটের সংগ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর ধারণা করা হয় মিস্টার চৌধুরি ২০১৩ সালে কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। আর মোহম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি জাপানে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক। আবু তারেক মোহাম্মদ তাজউদ্দিন কাউসার অস্ট্রেলিয়ায় বাস করেন কয়েক দশক ধরে। একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এরাই সম্ভবত বাংলাদেশের ভেতরের জঙ্গি ও বাইরের জঙ্গিদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, দুই থেকে তিন ডজন যোদ্ধা সম্ভবত সিরিয়া থেকে দেশে ফিরে এসছে। তারা বাংলাদেশে আইএসকর্মী হিসেবে কাজ করছে। আর অন্য অনেকে তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরেছে। আর তৃতীয় একটি গ্রুপ সম্ভবত বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তারা মিস্টার চৌধুরিকে আটক করতে বেশি তৎপর। এ ব্যক্তিকে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক- দ্য ডেইলি স্টার বাংলাদেশি জঙ্গিদের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, যার আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এ খবর যদি সত্যি হয়, চৌধুরীই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যে আইএস মুখপত্র দাবিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিল। সেখানে সে, স্থানীয় মুজাহেদিনদের সহায়তায় ভারতে রক্তক্ষয়ী হামলা চালাবে বলে হুমকি দিয়েছিল। সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল এ অঞ্চলের নাস্তিক, নবীর (সা.) অবমাননাকারী ও ধর্মত্যাগীদের গলা কাটতে আমাদের যোদ্ধারা ছুরিতে শাণ দিচ্ছে।
মিস্টার চৌধুরী ওন্টারিওর উইন্ডসর ছেড়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ফিরে যান। একই সময় দুই বন্ধু সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ তথ্য দিয়েছেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির উগ্রবাদ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচির গবেষক অমরনাথ আমরাসিংগাম। কানাডা ছাড়ার আগে চৌধুরি অভিযোগ করেন, তার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। আর মসজিদে তার বিশ্বাসকে সমালোচনা করা হয়েছে।
অন্য সন্দেহভাজন ওজাকি জাপান ছেড়েছেন কয়েক বছর আগে। জন্মেছেন একটি হিন্দু পরিবারে, বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান এবং সব শেষে কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ওখানে বসবাসকালে তিনি ধর্মান্তরিত হন এবং নাম বদল করেন। অন্য সন্দেহভাজনদের সঙ্গে তাদের পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই।
একজন সন্দেহভাজন নজিবুল্লাহ আনসারী। সে পড়তে গিয়েছিল মালয়েশিয়া। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সে তার ভাইকে শেষ সংবাদ পাঠায়। তাতে সে বলে আমি ইরাক এসেছি আইএস-এ যোগ দিতে। এর পর থেকে তোমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করব না। আর ফিরব না আমি।
জন্নুর সিকদার ছিলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তাকে ২০১৩ সালে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছে সে। এর পর জামিনে মুক্ত হয়ে সে মালয়েশিয়া চলে যায়। তার পর থেকে লাপাত্তা।
এটিএম তাজুদ্দিন কাউসার বাংলাদেশ ছাড়ে ২০০৬ সালে। অস্ট্রেলিয়া যায় কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে। ২০১৩ সাল থেকে পরিবারের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি সে।
জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে বিশদ কাজ করা বাংলাদেশি সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, এই ১০ সন্দেহভাজনকে ধরতে পারলে জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্র সম্পর্কে জানা যাবে। তিনি বলেন, চৌধুরিই সিরিয়া ও বাংলাদেশের জঙ্গিদের মূল যোগসূত্র। ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন মোহসিন আব্বাস।