হাসিমুখে কথা বলা সদকা
আতিকুর রহমান নগরী
মানুষ একে-অপরের ভাই। কুরআন বলেছে, ‘ইন্নামাল মুমিনুনা ইখওয়াহ’ আর হাদিসে নববীতে উল্লেখ আছে ‘আল-মুসলিমু আখুল মুসলিম’ তথা মুসলিম জাতি পরস্পর ভাই ভাই। এ জগৎসংসারে আমাদের সম্পর্ক, আত্মীয়তার কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। তবে সম্পর্ক পাকা হোক বা কাঁচা, দূরের হোক বা কাছের। সবাই তো এক নবীরই উম্মাত। আজকাল আমরা একে অপরের সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বা কখনো কখনো একেবারে অযথা বড্ড মেজাজ গরম করে, চোখ রাঙিয়ে ধমক দিয়ে কথা বলে থাকি।…হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কারোর সঙ্গে মোলাকাত করার মধ্যে যে কি যাদু-প্রভাব রয়েছে আদর্শের প্রচারকদের জন্যে তা একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এতে পারিবারিক জীবন অত্যন্ত আনন্দমুখর হয়…
এতে কী লাভ হয়। আমার বড়ত্ব, ক্ষমতা আর ধমকের সুর জাহির হয়। টেনশন আর উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি। হাসি মুখে কথা বলা খুব কঠিন কাজ মনে হয়। না, একটু-আধটু চেষ্টা করলেই পারবেন হাসিমুখে কথা বলতে।
মহানবী সা. বলেছেন, ‘তোমরা হাসিমুখে যদি নিজের ভাইয়ের প্রতি তাকাও, তাও সাদকায় পরিণত হয়। ‘হাসিমুখে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার গুরুত্ব অপরিসীম কিন্তু অনেকেই এ সম্পর্কে অনবহিত। অনেকেরই এ কথা জানা নেই যে তার ব্যক্তিত্বে কি পরিমাণ শক্তি লুকায়িত আছে এবং তার ঈষৎ হাসির মূল্য যে কী! অপরের হৃদয়ে নিজের আসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে, সহাস্যবদনে তার সঙ্গে মিলিত হওয়াই একমাত্র পন্থা। মুখে কথা বলা অপো সামান্যতম শুভেচ্ছামূলক হাসিরই প্রভাব অধিক হয়ে থাকে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যেন প্রথম সাক্ষাতেই আগত ব্যক্তিকে এই বলে স্বাগত জানায় যে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’। আর গম্ভীর এবং কোঁচকানো ভুরু ব্যক্তিকে দেখামাত্রই আপনি মনে করবেন যে, তার বর্তমান অবস্থা যেন আপনাকে অবহেলা করে বলছে, ‘তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। আমি তোমাকে ভালোবাসি না’। মানুষকে নিজের থেকে দূরে সরানোর জন্যে কর্কশ ব্যবহারই যথেষ্ট। তবে যার একান্ত ইচ্ছা মানুষের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টি করা, মানুষের মনকে হাতের মুঠোর মধ্যে আনা, তার হৃদয় জয় করা এবং তার জীবনের ল্য, আদর্শ ও চিন্তাধারাকে এক মহৎ উদ্দেশ্যে আমূল পরিবর্তন করা এমন ব্যক্তি এটা কিছুতেই পছন্দ করবে না যে তার কোনো অশোভন আচরণের দরুন মানুষ তার থেকে দূরে সরে যাক। এরূপ কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তির জন্যে উচিত, সর্বদা হাসিমুখে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা এবং সর্বদা ভদ্রোচিত ব্যবহার করা। মানুষের মন জয় করার জন্যে এটা সত্যিই শ্রেষ্ঠতম উপায়।
সাক্ষাতে কারো সঙ্গে হাসিমুখে মিলিত হওয়া সম্পর্কে উপরে যা কিছু বলা হয়েছে, এর মানে এ নয় যে, স্বার্থোদ্ধারকারীদের মতো কৃত্রিম হাসি দ্বারা সাময়িকভাবে মানুষকে খুশি করতে হবে। এরূপ হাসিকে মানুষ স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার এবং বিদ্রƒপাত্মক বলেই মনে করে, যা কোন ব্যাপারে ধোঁকা দেয়ার জন্যেই মানুষ করে থাকে। বরং এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাধারণত বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মানুষ যেরূপ আন্তরিকতার সঙ্গে হাসিমুখে মিলিত হয়, তেমন অকৃত্রিম হাসি। এরকম স্নেহ-ভালোবাসা মিশ্রিত হাসিই অপরের মনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।
যে-কোন প্রকার সফলতা অর্জন করতে হলেই সন্তুষ্টচিত্তে মানুষের সঙ্গে মেশা আবশ্যক। এমনিতেই মানুষ বহু সময় অযথা হাসিখুশিতে নষ্ট করে। তা না করে এ সময়টাকে এক মহত্তর উদ্দেশ্যে অপরের সঙ্গে হাসিখুশিতে কাটানো যেতে পারে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অতি সহজেই আপনার প্রতি আকৃষ্ট হবে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কারোর সঙ্গে মোলাকাত করার মধ্যে যে কি যাদু-প্রভাব রয়েছে আদর্শের প্রচারকদের জন্যে তা একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এতে পারিবারিক জীবন অত্যন্ত আনন্দমুখর হয়। সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে এরূপ ব্যবহার হয় যথেষ্ট সহায়ক। এক কথায় অপরের মন জয় করার জন্যে এটা একটা মস্তবড় উপায়।
আর এরূপ করার যদি আপনার অভ্যাস না থাকে, তাহলে আপনি এর অভ্যাস করুন। হয়তো কোন ব্যাপারে আপনি পীড়া অনুভব করছেন, এখন আপনার মধ্যে কেবল বিরক্তি বিরক্তি ভাব, সেক্ষেত্রে এরূপ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে আপনাকে সচেষ্ট হওয়া উচিত। কেননা বিরক্তি অনুভব করেই বা লাভ কী? এতে তো আপনার মনের অস্থিরতা যাবে না। ব্যস্ততা বা বিরক্তিভাব প্রকাশে সমস্যার আদৌ সমাধান হবে না। বরং যতই আপনি পীড়া অনুভব করবেন, ততই আপনার মানসিক ও দৈহিক শক্তি লোপ পেতে থাকবে। ক্রমেই আপনি ধৈর্যশক্তি হারিয়ে ফেলবেন। এটা অবশ্য ঠিক যে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কর্ম-প্রবাহে তাকে মাঝে মাঝে এমন কিছু অপ্রীতিকর এবং অবাঞ্ছিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, যাতে সে সময় মনের স্বাভাবিকতা রা করা এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে মানুষ যদি প্রথমত ছোট-খাটো অবাঞ্ছিত ব্যাপারে ধৈর্যের পরিচয় দিতে শেখে তাহলে তার জন্যে বিরাট বিরাট কষ্ট ও বেদনাদায়ক ব্যাপারও সহ্য করা সহজ হয়ে ওঠে।
চেহারা সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকা, মৃদু মৃদু হেসে কথা বলা, হাসিমুখে কারো সঙ্গে আলাপ করা এক কথা, আর অযথা অস¤পৃক্তভাবে হি হি করা অন্য কথা। কিছু সংখ্যক লোক বিশ্রীভাবে হাসি-ঠাট্টা এবং অশোভনীয় ও দায়িত্বহীন আলাপ-আলোচনা করাকে ‘হাসিমুখে কথা বলা’ মনে করে থাকে। অপরকে ব্যঙ্গ করা, অযথা ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা এবং মানুষকে পেরেশান করাই তাদের দৃষ্টিতে হাসিখুশি থাকার পদ্ধতি। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে আপনি অপরের হৃদয়কে হাতের মুঠোয় আনা তো দূরের কথা, বরং আপনার থেকে আরো বেশি দূরে সরে যাবে।
আসুন, অযথা হাসি যা কুরআন-হাদিস নিষেধ করেছে, তা থেকে বেঁচে থেকে সমাজের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কথা বলে একটি সদকার সওয়াব অর্জন করি। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রতিটি ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করার তাওফিক দান করুন। আমিন