ইসলামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হারাম
কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
চরমপন্থার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে অন্ধতা। চরমপন্থী বা গোঁড়া ব্যক্তি নিজের মতের প্রতি একগুঁয়ে ও অসহিষ্ণুর মতো এমন অটল থাকে যে, কোনো যুক্তিই তাকে টলাতে পারে না। অন্য মানুষের স্বার্থ, আইনের উদ্দেশ্য ও যুগের অবস্থা সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। তারা অন্যের সঙ্গে আলোচনায়ও রাজি হয় না, যাতে তাদের মতামত অন্যের মতামতের সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যায়। তাদের বিবেচনায় যা ভালো হয় শুধু তা অনুসরণেই তারা প্রবৃত্ত হয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাবোধ করে না। এমনকি কোনো হত্যাকা-ের মতো মারাত্মক অপরাধের পথও বেছে নিতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করিও না; নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ সূরা কাসাস : ৭৭…বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে রক্তপাত ঘটানো, স্থাপনা ধ্বংস করা, নিরপরাধ লোকের প্রাণনাশ করা, সুরক্ষিত বৈধ সম্পদ ধ্বংস করা, লোকদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি করা এবং তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় বিঘœ ঘটানো কখনোই প্রকৃত মুসলমানের কাজ হতে পারে না…
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘সে ঈমানদার নয়, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ এখানে প্রতিবেশী বলতে নির্দিষ্ট কাউকে নির্দেশ করা হয়নি। সে মুত্তাকি হতে পারে, নাও হতে পারে; অমুসলিম হতে পারে আবার দুর্বৃত্তও হতে পারে। ইসলামি আদর্শের অনুসারী না হওয়ার কারণে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা যাবে না। ইসলামে আহবান করার মূল মাধ্যমে হচ্ছে সদাচরণ, যা ছিল মহানবী সা. ও তাঁর সাহাবিদের বৈশিষ্ট্য। মহানবী সা. বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে তার জন্য বেহেশত হারাম, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে আমার উম্মতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমার দলভুক্ত নয়। মুসলিম
সব মানুষের সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে মহানবী সা. বলেন, ‘ তোমরা পরস্পরের ত্রুটি অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, ঘৃণা করবে না, পরস্পরের ক্ষতির উদ্দেশ্যে কাজ করবে না, বরং তোমরা সবাই আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে পরস্পর ভাই হয়ে যাও।’ বুখারি-মুসলিম
বিদায় হজের ভাষণে রাসুল সা. সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা ধর্মে জোর-জবরদস্তির ফলে তোমাদের পূর্ববতী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষের জীবন প্রকৃতিনির্ভর। তাই আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ কোনো কিছু মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হতে পারে না। তাই সব ধরনের গোঁড়ামি বা অন্ধ ধারণা আর চরমপন্থা পরিহার করে বিশ্বনিয়ন্ত্রক প্রদত্ত বিধান অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত। যে মানুষটি চরম দুর্বৃত্ত বলে সমাজের মানুষের কাছে ঘৃণীত অথবা যে মানুষটি চরম নীতিহীন বা ধর্মোদ্রোহী- যাকে কেউ ভালোবাসে না, তাকেও মহান আল্লাহ তায়ালা বাঁচিয়ে রাখেন। পৃথিবীতে তার খাওয়ার অধিকার বা চলাফেরার অধিকার আল্লাহ তার কাছ থেকে কেড়ে নেন না। আর মানুষের মুক্তির জন্য বা মানুষকে স্বর্গে নেয়ার জন্য কোনো একটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আল্লাহ দায়িত্ব দেননি। মানুষের জন্য আল্লাহর চেয়ে দয়াময় আর কেউ নেই।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাউকে আঘাত করা বা কাউকে কষ্ট দেয়া ইসলামে কোথাও সমর্থন করা হয়নি। ইসলামের উত্তম আদর্শে মুগ্ধ হয়েই যুগে যুগে মানুষ ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. তায়েফের ময়দানে অমুসলিমদের নির্যাতনে রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও তাদের প্রত্যাঘাত করার কথা ভাবেননি। ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ- ‘আপনি আপনার পালনকর্তার পথের দিকে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও উত্তম উপদেশগুলোর দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন।’ সূরা নহল : ১২৫
আল্লাহ বলেছেন, ‘দ্বীনের (ধর্মের) ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই।’ সূরা বাকারা : ২৫৬
রাসুল সা. কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি তাদের ওপর জোরজবরদস্তিকারী নন। অতএব যে ব্যক্তি আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন।’ সূরা কাফ : ৪৫
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে চরমপন্থা গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো হয় কিছু বিপথগামী মুসলমানের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার কোনো মুসলমান যার ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে, তার দ্বারা এ ধরনের চরমপন্থা অবলম্বন করা সম্ভব নয়।
লোকদের কাফের প্রতিপন্ন করা, বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে রক্তপাত ঘটানো, স্থাপনা ধ্বংস করা, নিরপরাধ লোকের প্রাণনাশ করা, সুরক্ষিত বৈধ সম্পদ ধ্বংস করা, লোকদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি করা এবং তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় বিঘœ ঘটানো কখনোই প্রকৃত মুসলমানের কাজ হতে পারে না। ইসলাম মুসলিমদের জান-মাল, দেহ ও মান-সম্ভ্রমকে হেফাজত করেছে আর ওইসব নষ্ট করাকে কঠোরভাবে হারাম করেছে। আর এটাই ছিল রাসুল সা. এর স্বীয় উম্মতকে লক্ষ্য করে শেষ বক্তব্য। ইসলামে অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যার লাইসেন্স যেমন দেয়নি, তেমনি আত্মঘাতী বোমা হামলারও কোনো অনুমতি নেই। তাছাড়া সন্ত্রাসবাদ ইতিবাচক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো বুনিয়াদ নয় বিধায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আদর্শ সমাজ গঠনে ইসলামের কোনো ভিত্তি নয়। আল্লাহ তায়ালা নিরপরাধ লোকদের হত্যাকারীকে কঠোর ধমকি দিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে স্বেচ্ছায় হত্যা করবে তার পরিণতি জাহান্নাম, তাতে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হন, তাতে অভিশাপ করেন আর তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ সূরা নিসা : ৯৩
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন সব লোক আছে যাদের প্রার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা নিজেদের মনের কথার ব্যাপারে সাক্ষী মানে আল্লাহকে। প্রকৃতপক্ষে তারা কঠিন ঝগড়াটে লোক। যখন ফিরে যায় তখন চেষ্টা করে যাতে সে অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্রের ধ্বংস সাধন ও প্রাণনাশ করতে পারে। আল্লাহ ফ্যাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না। আর যখন তাদের বলা হয় যে, আল্লাহকে ভয় করো, তখন তার পাপ তাকে অহঙ্কারে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। নিঃসন্দেহে তা হলো নিকৃষ্টতম ঠিকানা।’ সূরা বাকারা : ২০৪-২০৬
লেখক : আলেম ও কলামিস্ট