সুখী মানুষ ও সৌভাগ্যের আলপনা
আবদুস সাত্তার আইনী
সৌভাগ্যের অন্বেষণ সব জায়গাতেই মানুষের চিন্তা ও ভাবনার বিষয়। যারা সৌভাগ্যের ভুল পথে হাঁটে এবং সৌভাগ্যের অলীক চিন্তার পেছনে ছোটে তাদের সংখ্যা কতই না বেশি! তারা দুর্ভাগ্য ও অস্থিরতা ছাড়া আর কিছুই আয় করতে পারে না। কেবল প্রকৃত মুমিনই সুখ-সৌভাগ্য ও উত্তম জীবনের পথ ও পন্থা জানেন, জীবনের বৃহৎ অঙ্গনে তিনি সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকেন। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা তাঁর চোহারাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে ওই সৌভাগ্যকে আড়াল করতে পারে না। কারণ, তাঁর সৌভাগ্য হলো উচ্ছল-পরিপ্লাবিত প্রস্রবণ, তা সবসময় প্রবহমান থাকে, যেমন শিলারাশি থেকে পরিষ্কার-সুমিষ্ট জল প্রবহমান থাকে।
শায়খ আলি আত-তানতাবি রহ. তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে একাধিক নিবন্ধে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। একটি নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘শক্তিতে ও সামর্থ্যে সমকক্ষ দুজন ব্যক্তি একই ওজনের বোঝা বহন করলো। তাদের একজন অভিযোগ করলো এবং বিড়বিড় করে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে লাগলো, যেনো সে একা দুটি বোঝা বহন করেছে। অন্যজন মুচকি হাসছে এবং বোঝা বহন করাটাকে ‘কিছুই না’ ভাবছে, যেনো সে কোনো বোঝাই বহন করে নি। একইরকম স্বাস্থ্যের অধিকারী দুজন ব্যক্তি শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলো। তাদের একজন কুসংস্কারাচ্ছন্নের মতো কুলক্ষণ দেখতে থাকলো, ভয় পেতে থাকলো, তার চোখের সামনে মৃত্যু ভেসে উঠতে থাকলো। ফলে সে ব্যাধিতেই আক্রান্ত হয়ে থাকলো, ব্যাধি থেকে মুক্তি পেলো না। অন্যজন ধৈর্যধারণ করলো, আশাবাদ পোষণ করলো, সুস্থতার চিন্তা করতে থাকলো, ফলে সে দ্রুত আরোগ্য লাভ করলো এবং সুস্থ হয়ে উঠলো।’ সুয়ার ওয়া খাওয়াতির : পৃষ্ঠা ১৪
আলি আত-তানতাবি রহ. এরপর আরেকটি লোকের গল্প বলেছেন। লোকটি তার শেষ বয়সে এক বিস্ময়কর অলীক ধারণার শিকার হয়েছিলেন। তিনি মনে করতে শুরু করলেন, তার পাকস্থলীতে একটি সাপ রয়েছে! তিনি চিকিৎসকের কাছে ছুটে গেলেন, হেকিম-কবিরাজ দেখালেন। কিন্তু চিকিৎসক-কবিরাজরা লুকিয়ে লুকিয়ে হেসে কুটি কুটি হলেন। তাঁরা তাঁকে জানালেন, পাকস্থলীতে এক ধরনের কীট থাকে (খাদ্য-হজমে সহায়তার জন্য)। কিন্তু সাপ কিছুতেই পাকস্থলীর বাসিন্দা হতে পারে না। কিন্তু লোকটি তাঁদের কথা বিশ্বাস করলেন না। অবশেষে তিনি একজন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ চিকিৎসকের কাছে গেলেন। এই চিকিৎস মানুষের মনস্তত্ত্ব-বিষয়ে বেশ প-িত ছিলেন। তিনি বৃদ্ধ লোকটির ঘটনা শুনলেন। তাঁকে জোলাপ পান করালেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, আপনার পেটের সাপ (মলদ্বার দিয়ে) বেরিয়ে গেছে। এই কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি সুস্থতাবোধ করলেন এবং তাঁর শরীর চাঙা হয়ে উঠলো। অথচ ইতোপূর্বে তিনি নিজের ওপর চাপ অনুভব করতেন, ক্লান্তিতে হাঁপাতেন, কাঁদতেন, যন্ত্রণাবোধ করতেন!
এই বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করার পর শায়খ আলি আত-তানতাবি রহ. বলেছেন, ‘ওই বৃদ্ধ আসলে এভাবে আরোগ্য লাভ করেন নি যে, তাঁর পাকস্থলীতে একটি সাপ ছিলো এবং তা বেরিয়ে গেছে। বরং সাপটি ছিলো তাঁর মস্তিষ্কে এবং তা উড়ে গেছে। কারণ, তিনি তাঁর আত্মার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন, যা আগে ঘুমিয়ে ছিলো। মানুষের আত্মায় রয়েছে অপরিসীম শক্তি, যখন তোমরা জানবে কীভাবে সেই শক্তি থেকে উপকৃত হওয়া যায়, তোমাদের জন্য বিস্ময়কর কা- ঘটে যাবে।’
এরপর তিনি বলেছেন, ‘তোমরা তো ঐশ্বর্যশালী; কিন্তু তোমরা যে কী পরিমাণ ঐশ্বর্যের অধিকারী তা তেমারা জানো না। তাই তোমরা তা ছুঁড়ে ফেলে দাও তাতে অনাগ্রহী হয়ে বা উপেক্ষা ও অবহেলা করে।’
‘তোমাদের কেউ মাথাব্যথা বা পেট-কামড়ানি বা দাঁতব্যথায় আক্রান্ত হয়, তখন সে তার চোখের সামনে দুনিয়াকে কালো-অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখে। তাহলে কেনো সে যখন সুস্থ থাকে পৃথিবীকে আলোকোজ্জ্বল-জ্যোতির্ময় দেখে না? কেনো তোমরা হারানোর পূর্বে সম্পদ ও ঐশ্বর্যের মূল্য বুঝো না?’ ‘কেনো আমরা দূরে সরে যাওয়ার পূর্বে সৌভাগ্য দেখতে পাই না? কেনো আমরা তা অতীতকালের গর্ভে নিমজ্জিত অথবা ভবিষ্যতের কুহেলিকায় আচ্ছন্ন দেখতে পাই?’
‘তোমাদের কেউ কি এক লাখ ডলারের বিনিময়ে তার দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে ফেলতে রাজি হবে?’
লেখক : আলেম, কলামিস্ট ও অনুবাদক