স্মৃতির বিড়ম্বনা কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ দিবসের উৎসব
ডা. আবুল হাসনাত মিল্টন
ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমি কোনো মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেডিকেল পড়লে যা হয় আর কী! তবু যখন দূর থেকে শুনি মিটফোর্ডে ক্লাস নিতে গিয়ে জব্বার স্যার কিংবা বারডেমের মহাপরিচালক নাজমুন্নাহার ম্যাডাম ভরা মজলিশে তাদের এই তুচ্ছ ছাত্রটির প্রসঙ্গ তুলে গর্ববোধ করেন, তখন ভালো লাগে বৈকি। ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনা ঠিকঠাক না করলেও সংস্কৃতি, রাজনীতি, আড্ডাবাজি সবখানেই তো ছিলাম। আজ এতবছর পরেও ওই ক্যাম্পাস তাই ডাকে। সুযোগ পেলেই ছুঁটে যাই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জন্মদিন ১০ জুলাই। আমাদের সময়ে ছাত্র সংসদের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধীনে দিনব্যাপী উৎসব, কলেজ চত্বরে মীনা বাজারের মাধ্যমে দিনটি পালিত হতো। ঢামেকসুর সমাজকল্যাণ সম্পাদক হিসেবে আমিও একবার বিভাগীয় সদস্য ডা. আব্দুন নুর তুষার আর ডা. আরিফুল ইসলামের সঙ্গে মিলে দিবসটি উদ্যাপনের যাবতীয় আয়োজন করেছিলাম। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলামনাই এসোসিয়েশন গঠিত হলে তাদের আয়োজনে আরও বৃহত্তর আঙ্গিকে প্রতিবছর ১০ জুলাই বা তার আশেপাশের সুবিধাজনক কোনো সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ দিবস পালিত হওয়া শুরু হয় যা আজ অবদি চলছে। প্রতিবছরই এইদিনে কলেজ ক্যাম্পাসটি দেশ-বিদেশের সহস্রাধিক ডাক্তার-ছাত্রের উপস্থিতিতে পরিণত হয় এক অভূতপূর্ব মিলনমেলায়, পুনর্মিলনীতে। আমি প্রতিবছরই এই দিনটিতে উপস্থিত থাকার জন্য নিউক্যাসেল থেকে যাবার চেষ্টা করি। যে বছর যেতে পারি না, সেবার সারাদিন মন খারাপ করে থাকি আর কিছুক্ষণ পরপর ফেসবুকে ঢু মারি। বিভিন্ন জনের পেজে আপলোড করা ছবি দেখি।
কাজের ব্যস্ততায় গত কয়েক বছর আমি যেতে পারিনি। এবার তাই যাব বলেই ঠিক করে রেখেছিলাম এবং নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে হাজির। এবার ডিএমসির উৎসবের দিন আবার আমার জন্মদিন ছিল। তাই সবকিছুই স্পেশাল। সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ঝুম বৃষ্টি, সুতরাং ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও র্যালিতে যাওয়া হলো না। গাড়িতে কলেজ মিলনায়তনের গেটে নামিয়ে দিয়ে আজাদ চলে গেল। মিলনায়তনের ভিতরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা চলছে। দেশে গেলে আজকাল আর খুব একটা বক্তৃতা শোনা হয় না, অনেকটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলি। তাছাড়া, অনাকর্ষণীয় বক্তৃতা শোনার মতো ধৈর্যও ইদানিং অনেক কমে গেছে। মিলনায়তনের ভিতরে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই ছুটে আসে দুই তরুণী, একজনের হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা, কবির সঙ্গে ছবি তুলতে চায়। ছবি তোলার সময়ে অনেকটা ছোঁ মেরেই আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে প্রিয় কামরুল হাসান মিলন। যতই বলি ভিতরে যাব না, ততই সে নাছোড়বান্দা। শুধু তাই নয়, হাত ধরে একেবারে স্টেজের দ্বিতীয় সারিতে। সামনের সারিতে বসে আছেন শ্রদ্ধেয় আমির হোসেন আমু ভাই, অধ্যাপক মোদাচ্ছের আলী স্যার, প্রিয় ডা. জালাল ভাই, ডা. ইকবাল আর্সলান ভাই, ডা. শফিকভাইসহ আরও অনেকে। আমু ভাই, জালাল ভাইয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আটকে গেলাম, এখন আর চাইলেও বক্তৃতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নামা যাবে না। থেমে থেমে তরুণীদের এসএমএস আসছে। ‘স্টেজে বসে কী করেন? নামেন, আড্ডা দেই’ আমি বসে মনে মনে কামরুলরে গালি দেই।
সামনে তাকিয়ে দেখি, মিলনায়তনের দোতলার প্রায় পুরোটাই ফাঁকা, মাত্র তিনজন দর্শক বসে আছেন। নিচেও বেশকিছু আসন শূন্য। অনেকদিন পরে দেখলাম, একটি আলোচনা সভার একাধিক উপস্থাপক, তাও আবার একই লিঙ্গের। ব্যাপারটা এমন নয় যে, লিঙ্গ সমতায় একজন উপস্থাপক আরেকজন উপস্থাপিকা। এর মধ্যে একটি পর্ব আবার পরিচালনা করলেন সিনিয়র পর্যায়ের একজন নেতা। পদক তুলে দেবার পর্বটুকু একটু বেশিই অগোছালো ছিল, আমু ভাইকেও বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেল। দর্শকসারিতে উপস্থিত লোকজন খুব একটা আগ্রহের সঙ্গে বক্তৃতা শুনছে বলে মনে হলো না। বক্তাদের দীর্ঘ তালিকা শেষে মাননীয় প্রধান অতিথি হিসেবে যখন আমু ভাই মাইকের সামনে তার মূল্যবান বক্তব্য রাখতে দাঁড়ালেন, ততক্ষণে দর্শকদের শ্রবণযন্ত্র অতিষ্ঠ। আমু ভাই কেন জানি খুব বেশি কিছু বললেন না, অথচ জীবিত কিংবদন্তী এই মানুষটার কাছে অনেককিছু শোনার ছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ দিবসের এই আয়োজনটি বেশ ব্যাপক। এলামনাই এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন বাবু ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হয়। এই আয়োজনের পেছনে বাবু ভাই, অধ্যক্ষ ইসমাইল ভাই, শামীম ভাই, দেবেশ, মশিউর, আফজাল রাণাসহ অনেক মানুষের (সবার নামও আমি জানি না বলে দুঃখিত) অনেক দিনের নিঃস্বার্থ শ্রম জড়িত। এতবড় আয়োজনে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকাও স্বাভাবিক, সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং যাদের শ্রমে প্রতিবছর এতবড় একটা অনুষ্ঠান হয়, তাদের সবাইকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। সবখানেই নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো এমন লোকের বরাবরই অভাব।
এমন কাক্সিক্ষত একটি অনুষ্ঠানকে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে কী করে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, তা নিয়ে বোধ হয় ভাবার সময় এসেছে। এই নিয়ে আমারও দুয়েকটা পরামর্শ আছে। প্রথমত, দিবসের উদ্বোধনী আলোচনা অনুষ্ঠানটিকে অবশ্যই সংক্ষিপ্ত করতে হবে এবং তা যেন কিছুতেই একঘণ্টার বেশি না হয়। এদিন আমরা মূলত প্রধান অতিথির বক্তৃতা শুনতে চাই। এছাড়া এলামনাইর মহাসচিবের পরিচালনায় অধ্যক্ষের স্বাগত ভাষণ, সভাপতির ভাষণসহ দুয়েকজনের শুভেচ্ছা বক্তব্য শোনা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে, পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠানে, স্মৃতির মিলনমেলায় কতিপয় চেনা মুখের অপ্রাসঙ্গিক বক্তৃতা প্রতিবছর পালা করতে শুনতে কার ভালো লাগে? কোনো কোনো বক্তা কি অনুধাবন করতে পারেন, তার অনাকর্ষণীয় বক্তৃতা উপস্থিত দর্শকদের কর্ণকূহরে কতটা বিরক্তি ঢালে? ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাড়াও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুবাদে এসব প্রতিষ্ঠানের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু ডিএমসির মতো এমন বিরক্তিকর ম্যারাথন আলোচনা সভা আর কোনো পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আমি দেখিনি। তাও যদি বক্তৃতাগুলো তেমন আকর্ষণীয় হতো। তাছাড়া, আমরা তো প্রতিনিয়ত নেতাদের আদেশ-উপদেশ-কথা-ভাষণ শুনছিই। এই একটা দিন আমাদের মাফ করলে হয় না?
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন