প্যাঙ্গোলিন তো আর পেঙ্গুইন নয়
একটু একটু করে নয়, বড় দাগেই প্রমাণিত হচ্ছে গণতন্ত্রের চর্চায় আমরা কেউ আন্তরিক নই। আওয়ামী লীগের ভুল বিএনপির কাঁধে, বিএনপির ভুল আওয়ামী লীগের কাঁধেÑ এভাবেই দোষারোপের রাজনীতি আমাদের গণতন্ত্রের মডেল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে দেশ দিনদিন খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাবে এবং নিজেরাই এর পরিণাম ভোগ করব এই সহজ রাজনৈতিক শিক্ষাটা কেউ নেবেন না এটাই যেন সত্য।
না। জঙ্গি ইস্যু বা ভোটের রাজনীতি, এর কোনো কারণেই গণতন্ত্রের অভাববোধ নিয়ে আজকের বিষয় না। ইস্যু আমাদের প্রকৃতি, আমাদের পশুপাখি। আমাদের মানুষরাই যেখানে বিপন্ন সেখানে প্রাণিদের অধিকারের বিষয়টি বাড়াবাড়ি ঠেকে বৈকি।
সুন্দরবনকে ইউনেস্কো প্রস্তাবিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা ‘সংরক্ষিত প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনপূর্ণ অঞ্চল’ ঘোষণায় আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরোপুরি খুশি হইনি। এর আগে আয়োজন করে অনলাইনে ভোট দেবার আদিখ্যেতাতেও আমার সন্দেহ ছিল। সেটা মনে হয়েছিল আইওয়াশ। শুরুতেই মূল দাবি করা উচিত ছিলÑ সুন্দরবনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডেঞ্জার’ বা বিপন্ন মৃতপ্রায় অঞ্চল ঘোষণা করা। তাহলে এই জাতীয় কার্বন, মার্কারি, এসিড গ্যাস ইত্যাদি বর্জ্য উৎপাদন করা কোনো প্রকল্পই সেখানে করার পরিকল্পনা কেউ করতে পারত না বলে আমার বিশ্বাস। আন্তর্জাতিক আদালতের আওতায় তা হতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইউনেস্কোর ‘রেইন ফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’ এখন প্রশ্ন তুলেছে খোদ ইউনেস্কোর সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা নিয়ে। যেখানে ইউনেস্কোর মূলকথায় বলা আছেÑ ‘বিশ্বের সকল মানুষের জন্য, অঞ্চলভেদে যে যেখানেই থাকুন না কেন সমঅধিকার সবার।’ তবে সেখানে পরিবেশঘাতী প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউনেস্কো নীরব কেন? যারা সুন্দরবন রক্ষা নিয়ে আন্দোলন করছেন তাদের উচিত সরকারের পাশাপাশি ইউনেস্কোকে এই প্রশ্নটা করা।
আচ্ছা বাদ দিন কাগুজে রাজনীতি। বরং রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কালে বিপন্নপ্রায় একটি ছোট্ট প্রাণীকে নিয়ে একটু অশ্রুমোচন করি। প্রাণীটির নাম ‘প্যাঙ্গোলিন’। যদি সেটা পেঙ্গুইন বা কোয়ালা কিংবা পা-া অথবা নিদেনপক্ষে শ্লথ বা প্লাটিপাস হতো সারাবিশ্ব একে রক্ষায় হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু এটি আমাদের সুন্দরবনে একাকী টিকে থাকা অসহায় বাঙালি জাতির প্রতিচ্ছবি যেন। তাই একে রক্ষা করার কোনো সমিতি নেই।
প্রায় ৩৫ বছর আগের ঘটনা। ছোটবেলায় স্কুলে যাবার পথে দড়িতে বাঁধা এইরকম এক প্রাণী প্রথম দেখেছিলাম। সেদিন জেনেছিলাম এই অদ্ভুত প্রাণীটির দেশি নাম ‘বনরুই’। এমন প্রাণী আমাদের পাশের পাহাড়-জঙ্গলে আছে সেদিনই জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম। মনে আছে, প্রাণীটি মাটিতে মুখ গুঁজে ছুটে পালাবার জন্য ছটফট করছিল। এরপর অনেক দিন পিঁপড়া আর পোকাভূক বনরুই নামের মাছের আঁশের চামড়াওয়ালা লাজুক প্রাণীটিকে দেখিনি। কিন্তু জেনেছি নিশাচর এই প্রাণীটি আমাদের আশেপাশেই নিভৃতে আছে। এখন জানলাম একমাত্র সুন্দরবনেই এই প্যাঙ্গোলিন নামের প্রাণীটি বহু কষ্টে টিকে আছে তবে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতবাণী করছেন রামপাল প্রকল্পের মতো পরিবেশ বিপর্যয়ে তা চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমার শৈশবের শেষ স্মৃতিটুকুর মতো।
আমি আগামী প্রজন্মের কাছে বনরুই দেখার গল্পটি হয়তো এমনভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলব, তারা ভাববে আমি ড্রাগন দেখেছিলাম।
সমস্যা নেই। জীবনের গল্পগুলো তো এভাবেই মিথ্যে পরিণত হয়।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন