আফিমের প্রভাব : ক্যাপটাগন বনাম পেন্টাগন
নারীদের অবস্থান এবং ভূমিকা নিয়ে আমরা কি সবাই একমত পোষণ করি। নারী নেতৃত্বের ব্যাপারে ধর্মীয় কিতাবে যা লেখা আছে, দীর্ঘদিন নারী নেতৃত্ব বিরাজমান থাকার পরও কি সবাই এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছে। ধর্মীয় অনুশাসন মানার ক্ষেত্রে সবাই কি একই স্টাইল অনুসরণ করে। সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য থাকবেÑ এটাই সংস্কৃতির সৌন্দর্য। ধর্মীয় জেনারিক পন্থিরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় স্টাইলকে শ্রেষ্ঠ দাবি করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা ধর্মীয় মনোলিথিক ধ্যান ধারণা দিয়ে বৃহত্তর সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করতে উদ্যত, এমনকি চাপাতিহস্ত। আমাদের সময়ে নবম-দশম শ্রেণির ইসলামি শিক্ষা বইয়ে ৪০টি হাদিস পড়ানো হতো। যে দুইটি হাদিস আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল সেগুলোর সারমর্ম হচ্ছেÑ ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’, ‘বিদ্যা অর্জন করা সকল মুসলমান নরনারীর জন্য ফরজ… বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও…।’ এখন ইউটিউবের বয়ানে হুজুররা (মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক ইউসুফ ও জসিম উদ্দীন রহমানী গং) বলেছেন, এই দুইটি হাদিস নাকি ভূয়া, এমন কোনো হাদিস নাকি নেই। প্রথম হাদিসটির অস্তিত্ব অস্বীকার করার তাৎপর্য হচ্ছে, মাতৃভূমি নয় খিলাফতের (আইএস) প্রতি আনুগত্যই ঈমানের অঙ্গ। আর অপরটি হচ্ছে বিজ্ঞান প্রযুক্তি নয় মধ্যযুগের মরু অঞ্চলের আরবি ও হিব্রুভাষা কেন্দ্রিক জ্ঞানই কেবল অর্জন করতে হবে বাকি সব বর্জনীয়। এই দুটি হাদিসের অস্তিত্ব অস্বীকার করাতে পারলেই মগজধোলাইয়ের অর্ধেক কাজ শেষ। এতেই খিলাফত বা পলিটিক্যাল ইসলামের দিকে তরুণদের ধাবিত করা যাবে। আর সেলবেজ ভ্যালু বা বেহেস্তের বিষয়টি তো হাতে থাকছেই। যার কারণে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া জিন্স, টি-শার্ট পরা তথাকথিত আধুনিক সিলেবাসে ব্যয়বহুল শিক্ষায় সনদধারী বা মাঝ পথে সনদের মোহ ত্যাগকারী তরুণরা ছুটছে খিলাফতের দিকে। মগজ ধোলাইয়ের আগে তাদের অনেকে বেড়ে উঠেছিল, উল্লাসিত সাংঘর্ষিক সংস্কৃতির বৈপরিত্যের মধ্যে, সহনশীল বৈচিত্র্যের মধ্যে নয়।
জঙ্গিবাদের সমস্যাটা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমানে প্রধান ইস্যু হলেও সমস্যাটি মোটেই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক সমস্যা নয়। এটা মূলত সমাজতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা। এর সঙ্গে মনস্তত্বও জড়িয়ে আছে। এর কোনো রাজনৈতিক সামাজিক সমাধান নেই। রাজনীতি দিয়ে নয় বরং সংস্কৃতি দিয়েই আমাদের এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র থেকে সাংঘর্ষিক বৈপরিত্যগুলো কমিয়ে আনা না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না। জঙ্গিবাদ একটি ফ্যাশন, লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘস্থায়ী একটি স্টাইলে হালে জনপ্রিয়তা পাওয়া একটি প্রবণতা। হুজুকের (ফ্যাড) মর্ত এটা দ্রুত উঠে দ্রুত নেমে যাবে কিনা তা নির্ভর করবে নতুন একটি ফ্যাশন বা মতবাদের আগমনের ওপর। এক সময় বামপন্থী হওয়া ফ্যাশন ছিল। আমাদের স্বাধীনতা উত্তর কালে এদেশের তরুণরা কিছু মুর্খ লোকের প্ররোচনায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ফ্যাশনে গা ভাসিয়েছিল। হাজার হাজার মেধাবী তরুণ যোগ দিয়েছিল অবৈজ্ঞানিক মেজর জলিল, আ স ম রব ও সাজাহান সিরাজদের দলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য। তারও আগ থেকেই গ্রামের অর্ধশিক্ষিত তরুণদের বিভ্রান্ত করেছিল। সাহারার একনায়কত্ব কায়েমের নামে গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষকদের হত্যার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ লেলিনবাদ কায়েমের সেøাগানধারী লাল পতাকাবাহীরা, যারা ছিল ধর্মবিরোধী। মার্কসবাদী, লেলিনবাদীরা ধর্মকে ‘অফিমস্বরূপ’ মনে করত বর্তমানে জঙ্গিদের সঙ্গে মাকর্সবাদীদের পার্থক্য হচ্ছেÑ জঙ্গিরা সত্যিসত্যি ধর্মকে অফিমস্বরূপ ব্যবহার করছে। অফিম মানুষের চেতনা নাশ করে শুনেছি। ছোট বেলায় আমার এক কবিরাজ জেঠাকে দেখতাম সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে গালাগাল করেছেন। তখন মা বলতেন তোর মুন্সি জেঠা অফিম খেয়েছে, এখন ওই দিকে যাস না। এখন বোধ হয় অফিমের প্রতিক্রিয়া বদলে গেছে। এবার কোপেনহেগেন গেলে স্নেহভাজন ডাক্তার বিদ্যুৎ বরুয়া আমাকে ‘গ্রিন লাইট সিটি’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখলাম, আর্মস্টারডেমে দেখা ‘রেডলাইট সিটির’ কিছুই সেখানে নেই। সবাই চুপচাপ বসে মাদক খাচ্ছে বা নিচ্ছে। দোকানিরা কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে অফিম মাজুয়ানাসহ বিভিন্ন মাদকের পরসা সাজিয়ে বসে আছে। পাঠক লক্ষ্য করবেন, খিলাফতিরাও মুখ ঢাকার জন্য কালো কাপড় ব্যবহার করে। তবে গ্রিন লাইট সিটিতে অফিম খেয়ে কাউকে মুন্সি জেঠার মতো উত্তেজিত হতে দেখিনি। সবাই অর্ধচেতন অবস্থায় ঝিমাচ্ছিল।
গুলশান হত্যায় জড়িত জঙ্গিরা ক্যাপটাগন খেয়েছিল কিনা তা জানতে ভিসেরা পরীক্ষার কাজ চলছে। আগেই পত্রিকায় খবর এসেছিল আইএস যোদ্ধারা ক্যাপটাগন নামের একটি ওষুধ সেবন করে। এটাই আইএস ড্রাগ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ক্যাপটাগন খেলে অনেক দিন না ঘুমিয়ে থাকা যায়। স্বাভাবিক চেতনা বিলুপ্ত হওয়ায় একের পর এক খুন করতে পারে। বিভ্রান্ত বিশ্বাসের আফিম আর নিউরো প্রযুক্তির ক্যাপটাগন এর প্রভাবে জঙ্গিরা হয়ে উঠেছে হিংস্র থেকে হিংস্রতর। তবে তারা জানে না এ দিয়ে তাদের লক্ষ্য কোনোদিনই অর্জন হবে না। যেমনটি পারেনি বিপ্লবের লাল পতাকা হাতে নিয়ে মাওবাদীরা সারা পৃথিবীতে বহু মানুষ হত্যা করেও হয়নি কমিউনিস্ট বিশ্ব প্রতিষ্ঠা বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তথা পেন্টাগনের পতন। মার্কিনী ও তাদের মিত্রদের কর্মকা-ের ব্যাপারে ক্ষোভ যথার্থ হলেও ক্যাপটাগন খেয়ে গুলশানে কিছু ইতালিয় ও জাপানি হত্যা করে কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না, কেবল মাতৃভূমির কিছু ক্ষতিসাধন হবে এ হামলার একমাত্র পাওনা। ‘মাতৃভূমিকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ’ এটি সঠিক হাদিস নয় তা হয়তো চাক্ষুস করানো যাবে। ইউটিউবে হুজুরদের দাবির পক্ষে সাক্ষী হওয়া যাবে। এর বেশি কিছু হবে না। পেন্টাগন অনেক দূরেই অক্ষত থেকে যাবে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন