বিপদে সুুন্দরবন?
বাংলাদেশ ও ভারতের মালিকানায় গঠিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে তৈরি করতে যাচ্ছে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রথমে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও ভবিষ্যতে এর ক্ষমতা বাড়িয়ে ২৬৪০ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হতে যাচ্ছে ৫৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন অরিওন বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই দুইটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে। আমাদের পাশের দেশ ভারত। যার মালিকানা রয়েছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র, তাদের নিজেদের দেশের ইআইএ গাইডলাইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বা কারখানা নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে এবং কোম্পানির পক্ষ থেকে সরকার বারবার গণমাধ্যমের কাছে দাবি করছে এই কেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২০ কি.মি. এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় না।
বঙ্গোপসাগর আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের এই সংযোগস্থলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। আমরা দেখেছি সুন্দরবন এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কিভাবে বর্মের মতো সাইক্লোনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে। এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাইক্লোনের প্রবণতা বেড়েছে। এবং আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যান্য সাইক্লোন প্রবণ অঞ্চলের তুলনায় সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চল সাইক্লোন দ্বারা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর তাই সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য এক প্রাকৃতিক সুরক্ষা। সুন্দরবন রক্ষা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সমপর্যায়। এই সুন্দরবন রক্ষা করার কথা কাগজে কলমে বহুবার বলা হলেও তা কি করা হচ্ছে?
এ বছরের ১৯ মার্চ সুন্দরবনকে বিপন্ন করে তার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত শ্যালা নদীতে ১ হাজার ৩০০ টন কয়লাবোঝাই জাহাজ ডুবে গেছে। এর আগে ২০১৪-এর ডিসেম্বরে জাহাজডুবিতে ছড়িয়ে পড়া তেল যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, তা নিরসনে কোনো প্রস্তুতি কিংবা ব্যবস্থা সরকারের ছিল না। নদী থেকে তেল সরানোর ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা, উদাসীনতা ও উদ্যোগহীনতার মুখে এলাকার বিভিন্ন বয়সী মানুষ জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে নিজেদের জানা-বোঝা মতো তেল সরিয়ে নিয়েছে। সেই সময় সরকারি বাগাড়ম্বর ও অকর্মণ্য ভূমিকা একই সঙ্গে অব্যাহত ছিল। দেশে ইউনেস্কো প্রতিনিধি দল সফর করছে বলে সরকার কয়লা জাহাজডুবির পর শ্যালা নদীতে জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনের কোনো গুরুত্ব সরকারের কাছে নেই। সেজন্যই সুুন্দরবনকে বিপদগ্রস্থ করে নৌ-পরিবহন বা বিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি বিষয়ে দেশ-বিদেশের উদ্বেগ তাদের কাছে গুরুত্বহীন।
বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার যেখানে যৌথভাবে সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে, সেখানে দুই দেশের সচেতন মানুষ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভিত রচনা করছেন। সুন্দরবন বাংলাদেশকে রক্ষা করে, সুন্দরবন রক্ষা তাই আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য, অখ- বিশ্বের অতুলনীয় সম্পদ; এটি রক্ষা করা সব মানুষেরই দায়িত্ব।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন