ভয়াবহরূপে ডেঙ্গুর বিস্তার, সাত মাসে আক্রান্ত ৫৩০, মৃত্যু পাঁচজনের
রিকু আমির : চলতি বছরের সাত মাসে রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৩০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। সর্বশেষ গতকাল সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান কাকন (১৩)।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সেলের ইনচার্জ ডা. আয়েশা আক্তার জানান, জুন মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পপি (১৫), শামীম (২৩), সাইফুন্নাহার ও কাজী রোকসানার (৩২) মৃত্যু হয়। পপি ও শামীম ঢামেক হাসপাতাল, সাইফুন্নাহার স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড হাসপাতাল ও কাজী রোকসানা সেন্ট্রাল হাসপাতালে মারা যান। এমন চিত্র দেখেই বিশেষজ্ঞরা দেশে এবার ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ঊর্ধ্বগতির পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে লাল কালিতে। সে অনুযায়ী, চলতি বছরের গত ছয় মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুসারে, গত এক দশকের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, অন্য বছরগুলোর তুলনায় (জানুয়ারি-জুলাই) ডেঙ্গু আক্রান্তের হার এ বছরই সর্বোচ্চ। ফলে ডেঙ্গুর মূল মৌসুম বলে পরিচিত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হার কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরই শঙ্কিত।
তথ্য মতে- গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। অন্যদিকে, গত জানুয়ারি মাসে ৯ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ২ জন, মার্চ মাসে ১৩ জন, এপ্রিল মাসে ৪১ জন, মে মাসে ৭৬ জন, জুন মাসে ১৮৩ জন ও জুলাই মাসে (২৫ তারিখ পর্যন্ত) ২০৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে।
অধিদফতর জানিয়েছে, গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল আগের ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। আর এবার পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে অবস্থা গত বছরের চেয়ে আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
আইইডিসিআরের তথ্য মতে, সাধারণত জুন-জুলাই থেকে শুরু করে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার থাকে। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি বেশি খারাপ থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় ইতোমধ্যে সবগুলো হাসপাতালে নির্দেশনা পাঠিয়েছি। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, ওষুধ বা উপকরণ সব হাসপাতালেই পর্যাপ্ত আছে। চিকিৎসকদেরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুর জীবাণুর উৎস বন্ধ হচ্ছে না বলেই এমনটা হচ্ছে। এসব উৎস বন্ধ না করতে পারলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে।
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্যান্য অনেক ভাইরাল রোগের মতো সরাসরি এরও কোনো প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে এর মোকাবিলা করা হয়। অন্য ভাইরাল ফিভারের মতো এটিও আপনা-আপনি সেরে যায় সাত দিনের মধ্যে। তবে যদি রোগীর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং হেমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরণকারী পর্যায়ে চলে যায় তখন দ্রুত ফ্রেশফ্রোজেন প্লাজমা কিংবা কনসেনট্রেটেড প্লেটলেট অথবা প্রয়োজনে পূর্ণ রক্ত-পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য সূত্র অনুসারে, বাংলাদেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব তীব্র হয়। তখন থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কেবল সরকারের সংগৃহীত তথ্য মতে, দেশে ২৮ হাজার ১০১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ২৪২ জন। এর মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল প্রথম পাঁচ বছর। ২০০০ সালে ৫৫৫১ জন আক্রান্ত হয়, মারা যায় ৯৩ জন; ২০০১ সালে ২৪৩০ জন আক্রান্ত হয়, মারা যায় ৪৪ জন; ২০০২ সালে ৬১৩২ জন আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ৫৮ জন। ২০০৩ সালে হঠাৎ ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। সে বছর আক্রান্ত হয় ৪৮৬ জন এবং মারা যায় ১০ জন। তবে এরপর পরিস্থিতি ফের খারাপ আকার ধারণ করে। ২০০৪ সালে আক্রান্ত হয় ৩৯৩৪ জন, মারা যায় ১৩ জন; ২০০৫ সালে আক্রান্ত হয় ১৫৮ জন, মারা যায় চারজন এবং ২০০৬ সালে আক্রান্ত হয় ২২০০ জন, মারা যায় ১১ জন। এর পর থেকে টানা চার বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর রেকর্ড নেই সরকারি হিসাবের খাতায়। যদিও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী প্রতিবছরই ছিল। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০১১ সালে। সে বছর ১৩৬২ জন আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ছয়জন। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম