কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি প্রধান আইটি বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানার ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস, সুইফট ও ৭ ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত
হাসান আরিফ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ব্যাংকের আইটি বিভাগের উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস, আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান সুইফট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ৭ কর্তকর্তা জড়িত বলে দাবি করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকসের প্রধান নির্বাহী ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা। চুরির ঘটনার পর তাকেই প্রধান আইটি বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ ধরনের তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান সুইফট এবং ভারতীয় একটি (ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস) সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান জড়িত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য না করে বলেন, তার যা বলার মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়ই বলেছেন। এর বাইরে তিনি কিছু বলবেন না বলে জানান। তবে মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে কি আছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। আর বিষয়টি তার জানার কথাও না। তবে প্রতিবেদনে যদি কারও সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বর্তমানে রাকেশ আস্তানার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুক্তি আছে না শেষ হয়েছে। আর বর্তমানে তিনি কোথায় অবস্থান করছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাকেশ আস্তানার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুক্তি বর্তমানেও বহাল রয়েছে। তবে তার সঙ্গে দুই ধরনের চুক্তি রয়েছে। প্রথমত: তিনি বাংলাদেশে থেকে কাজ করবেন, আর দ্বিতীয়ত: তিনি দেশের বাইরে থেকেও কাজ করতে পারবেন। তবে বাইরে থেকে কাজ করলে তার পারশ্রমিক কমে দেওয়া হবে। আর তিনি বর্তমানে বাংলাদেশে নেই।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করে আসছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর রাকেশ আস্তানাকে প্রধান আইটি বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ এখন তাকে ও তার প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য।
বিদেশি লোক দিয়ে আইটি বিভাগে কাজ করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন ফরাসউদ্দিন নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রাকেশ আস্তানাকে নিয়োগ দেওয়া হল। তিনি ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া করলেন ফায়ার আইকে। প্রায় ৩ কোটি টাকার বেশি ফায়ার আইকে দিতে হয়েছে। অথচ কাজের সফলতা বা অর্জন শূন্য।
এ বিষয়ে শুভঙ্কর সাহা বলেন, ফায়ার আই তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে আরও বৃহত্তর ভাবে কাজ করতে তারা চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়াতে চাইলে কেন্ত্রীয় ব্যাংক তাতে সম্মত হয়নি।
জানা গেছে, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ২ কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত। তারা জেনে শুনেই সহায়তা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ফৌজদারি দ-বিধিতে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও গত দেড় মাসে তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর অন্য ৫ কর্মকর্তার গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা ছিল। তাদের অসতর্কতা এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব ছিল। এছাড়া সুইফট ও ভারতীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস- বিপুল পরিমাণ অর্থ সরানোর ক্ষেত্রে কলকাটি নেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িতদের দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে আছে ৫ জন। এরা অদক্ষ, অথর্ব ও কাজে গাফিলতি করেছে। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে দুই জন। এদের অপরাধ গুরুতর। এই দু’জনের বিষয়ে আরও গভীরভাবে তদন্ত করা দরকার। বিশেষ করে ‘ক্রিমিনাল ল’ অনুযায়ী তদন্ত জোরদার করা প্রয়োজন।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির সময় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ১৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা গচ্ছিত ছিল। হ্যাকারদের সব টাকা নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বানান ভুলের কারণে তাদের সে মিশন থেমে যায়। তবে সব টাকা নেওয়ার মতো ব্যবস্থা হ্যাকারদের ছিল বলে সিআইডির একটি সূত্র দাবি করেছে। সূত্রটি বলছে, টাকা নেওয়ার মতো সব ‘দরজা’ই খোলা ছিল।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কমিটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন ৩০ মে অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস পার হতে চললেও এখনও তা প্রকাশ করা হয়নি। এ বিষয়ে সে সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ১০-১৫ দিনের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে। সর্বশেষ ঈদের আগে বলেছিলেন, ঈদের পরই প্রকাশ করা হবে।
উল্লেখ্য, ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে। আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার। শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংকে যাওয়া অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বদলে জুয়ার টেবিল ঘুরে চলে যায় নাগালের বাইরে। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম