পরচর্চা ও অন্যের সম্পর্কে আলোচনা
মুফতী আব্দুল্লাহ বিন রফিক
অন্যের সম্পর্কে কী ধরনের কথা বা আলোচনা শরিয়ত গীবত বলে গণ্য করে, এ ব্যাপারে সবার স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। কারণ সামাজিক জীবনে নানা প্রয়োজনে অন্যদের অনুপস্থিতে কথা প্রসঙ্গে তাদের সম্পর্কে আপন পরিবার বা বন্ধুদের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন পড়ে। আসল কথা হচ্ছে, কম-বেশি দোষ কিন্তু সবার মাঝেই আছে। কিন্তু অন্যেরা সেগুলো আলোচনা করলে আমার খারাপ লাগে। এমন সত্যিকারের দোষ নিয়ে কারও অনুপস্থিতিতে আলোচনা করার নামই হলো ‘গীবত’। ধরুনÑ লোকটা বেটে, রগচটা, দাম্ভিক, তোতলা, বিলাসী, ধুমপান করে, জামাত কাজা করে, স্ত্রী পর্দা করে না… ইত্যাদি দোষ-ত্রুটি তার মধ্যে সত্যি সত্যিই বিদ্যমান আছে। কিন্তু তাই বলে তার অনুপস্থিতে তার নামে দোষ চর্চা করা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও নিন্দিত কাজ বলে বিবেচিত হবে। অনেকে বলে, সত্য কথা বললে গীবত হয় কী করে? প্রকৃতপক্ষে গীবত তথা পরর্চচা তো সত্য কথাই হয়ে থাকে। প্রবৃত্তির তাড়নায় হয়তো এমনটা বলে ফেলি। কিন্তু এ কথাই বা আমরা বিস্মৃত হই কী করে যে, সকল সত্য কথা সবসময়ে বলার অনুমতি নেই। কিছু সত্য কথা তো এমন, যা মিথ্যার চে’ও জঘণ্য।
আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসূল ইরশাদ ফরমান, তোমরা কী জানো পরনিন্দা কী? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসূল বলেন, তোমার ভাইকে তার অনুপস্থিতে এমনভাবে উল্লেখ করা যা তিনি অপছন্দ করেন। তখন বলা হলো, আচ্ছা, আমি যা বলছি তা যদি সত্যিই আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তবুও কি গীবত হয়ে যাবে? রাসুল বলেন, তুমি যা বলছো তা যদি সত্যিই তার মধ্যে থাকে তাহলে তুমি তার গীবত তথা পরনিন্দা করলে। আর যদি না থাকে তাহলে তার ওপর বুহতান (ংষধহফবৎ) তথা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে। সহিহ মুসলিম: ২৫৮৯ ও ৬৩৫৯
গীবতের ভয়াবহতা
আত্মার এ ব্যধি ও ভাইরাসের সংক্রামক ছোবল এতটাই তীব্র ও ভয়াবহ যে, এ ব্যধিগ্রস্থ ব্যক্তিদের তাওবা করারই সুযোগ হয় না। আল্লাহর রাসূল বলেন, গীবত ব্যভিচারের চে’ও মারাত্মক। সাহাবায়ে কিরাম বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! গীবত ব্যভিচারের চে’ মারাত্মক হয় কীভাবে ? আল্লাহর রাসুল সা. বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি যিনা করার পর তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। তবে যার গীবত করা হয়েছে সে যদি মাফ না করে তাহলে তাহলে আল্লাহ তাআলা গীবতকারীকেও মাফ করবেন না। Ñমিশকাত: ৪৬৫৯; আস-সুনানুল-কুবরা বায়হাকি: ৬৩১৫
গীবত কীভাবে যিনার চে’ মারাত্মক হয় সে প্রসঙ্গে হাদীস বিশারদগণ বলেছেন, ব্যভিচারের পরে পাপীর হৃদয়ে অনুশোচনা জাগে, সে অস্থির হয়ে উঠে এ ভেবেÑ আমি এ কি করলাম? আল্লাহর ভয়ে সে শিহরিত উঠে। ফলে সে তাওবা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে এবং তাওবা করে। পক্ষান্তরে গীবতকারীর হৃদয়ে এই অনুভূতিই জন্মায় না যে, সে পাপ করেছে। ফলে কৃত পাপের জন্য অনুশোচনাও জাগে না। তাই তার ভাগ্যে তাওবা জোটে না। এভাবে গীবতকারী এক অন্তহীন ভয়াবহ পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গীবতের অন্যতম এক কুফল হচ্ছে, এতে নেক আমল মুছে যায়। আবু উমামা রা. বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসূল ইরশাদ ফরমান, বিচার দিবসে লোকেদের কাছে তার আমলনামা তুলে ধরা হবে। তখন সে বলবে, হে আমার রব! দুনিয়ার জীবনে আমি এই কাজ করেছিলাম কিন্তু আমার আমলনামায় তা দেখছি না। উত্তরে আল্লাহ বলবেন, লোকেদের গীবত করার কারণে তা তোমার আমলনামা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক. অন্যায় দেখলে সংশোধনের চেষ্টা করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু তাই বলে অন্যের সামনে গীবত করে সংশোধনের ফিকির করা বৃথা চেষ্টা মাত্র। এতে সংশোধন তো দূরের কথা, উল্টো বরং নিজেই পাপের ভাগীদার হতে হয়।
দুই. অন্যের দোষ তার অনুপস্থিতে বলার শরীয়তসম্মত যে কারণগুলো তা হলো, যদি অভিভাবক বা অন্য কাউকে বললে তার সংশোধনের আশা করা যায় অথবা তার দোষ বলা না হলে কারও জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলেই কেবল দোষটা বর্ণনা করার অনুমতি আছে। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এটি নিতান্তই ঘৃণিত কাজ।
তিন. আড়ালে অন্যের দোষ চর্চা করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি তা ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই। তারা একে অন্যের প্রতি যুলুম করে না, বিপদে পরিত্যাগ করে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে আল্লাহ তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসবেন। যে কোনো মুসলিমের কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তার কষ্ট দূর করবেন। যে কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন।’ সহিহ মুসলিম: ২৫৮০
চার. মুমিনের দায়িত্ব হলো, আপন অন্তরকে নিজস্ব ভুল-ত্রুটির স্মরণে এবং তাওবা ও দু‘আয় ব্যস্ত রাখা। অন্যের ভুল, অন্যায় ও পাপ ইত্যাদির চিন্তা মুমিনের অন্তরকে কলুষিত করে, অগণিত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে। ফলে হৃদয়ে অহমিকা জন্ম নেয়। সর্বোপরি আখিরাতকে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের সবার উচিৎ, কারও অনুপস্থিতে তার সম্পর্কে কোনো কথা বা আলোচনা পরিহার করা। সদা নিজের নিজের দোষ-ত্রুটির কথা চিন্তা করা এবং মুক্তির পথ খুঁজতে থাকা। আল্লাহ সহায় হোন। আমিন।