দীর্ঘ সময় নামাজ পরিত্যাগকারীর করণীয়
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
কেউ ঘুমিয়ে পড়লে অথবা ভুলবশত কিংবা অন্য কোনো বিশেষ কারণে কোনো ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতে না পারলে এই নামাজ পরবর্তীতে ওই (ফরজ) নামাজ কাজা পড়া জরুরি। প্রিয়নবি সা. বলেন, যে ব্যক্তি কোনো নামাজ পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে তার কাফফারা হল স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেয়া। অন্য এক বর্ণনায় বলেন, এছাড়া তার আর কোনো কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) নেই। বুখারি, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩
কাজা নামাজ পড়ার জন্য কোনো সময়-অসময় নেই। দিবা-রাত্রের যেকোনো সময়ে চেতন হলে বা মনে পড়লেই উঠে সর্বাগ্রে নামাজ পড়ে নেয়া জরুরি। অন্যথা পরবর্তী সময়ের অপেক্ষা বৈধ নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে যারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে দীর্ঘকাল নামাজ আদায় করেনি, তারা কি করবে? তারা কি কেবল খালেস দিলে ‘তওবা’ করলেই কাজ হবে? নাকি তার জীবনে কাজা হওয়া ‘ফরজ’ এবং ‘ওয়াজিব’ সব নামাজগুলো আদায় করতে হবে? তবে সর্বাবস্থায় সকলেই একমত, ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘসময়ের সালাত পরিত্যাগ করলে পরে সে সালাতের ‘কাজা’ করার বিষয়ে হাদিসে কোনোরূপ বিধান দেয়া হয়নি। সমাজে কিছু প্রচলিত ভিত্তিহীন কথাবার্তাও এ বিষয়ে প্রচলিত আছে। দুইটি ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। প্রথমটি উমরি কাজা ও দ্বিতীয়টি কাফফারা বা এস্কাত। এ বিষয়ে একটি হাদিস।
এক ব্যক্তি বলে, হে আল্লাহর রাসুল, আমি সালাত পরিত্যাগ করেছি। তিনি বলেন, তুমি যা পরিত্যাগ করেছ তা ‘কাজা’ কর। লোকটি বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কিভাবে তা ‘কাজা’ করবো? তিনি বলেন, প্রত্যেক ওয়াক্তের সালাতের সঙ্গে অনুরূপ সালাত আদায় করো। সে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আগে না পরে? তিনি বলেন, না বরং আগে।
মুহাদ্দিসগণ একমত, এই হাদিসটি জাল, ভিত্তিহীন ও বাতিল। যদি কোনো মুসলমান দীর্ঘদিন সালাতে অবহেলার পরে অনুতপ্ত হয়ে নিয়মিত সালাত শুরু করেন, তখন তার প্রধান দায়িত্ব হবে বিগত দিনগুলির পরিত্যক্ত সালাতের জন্য বেশি বেশি করে কাঁদাকটি ও তওবা করা। অপরদিকে অনেক ফকিহ বলেছেন, ওই ব্যক্তি পরিত্যক্ত সালাতগুলি নির্ধারণ করে তা ‘কাজা’ করবেন। ‘উমরি কাজা’ করার কোনো নির্ধারিত বিধান কুরআন বা হাদিসে নেই। মুসলিম ফকিহগণ এ বিষয়ে মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন আলেম বিভিন্নভাবে তাদের মত প্রকাশ করছেন। এক দল আলেমের মতেÑ কেউ যদি বিগত জীবনে দীর্ঘকাল বেনামাজি থাকার পর আল্লাহর ইচ্ছায় সুমতি হয়ে নামাজ শুরু করে তবে তাদের উচিত তাদের জিম্মায় থাকা ওইসব অআদায়ী নামাজের কাজা নামাজ দ্রুত আদায় করে নেয়া। নিয়মিত নামাজের পাশাপাশি ওই সমস্ত নামাজের কাজা আদায় করতে হবে। কাজা নামাজ আদায় করার সময় এ নিয়ত করতে হবে, আমি অমুক দিনের জোহরের নামাজ কাজা আদায় করছি। আর যদি দিন-তারিখ মনে না থাকে, এমতাবস্থায় এভাবে নিয়ত করতে হবে আমি আমার জীবনের সর্বপ্রথম জোহর নামাজের কাজা আদায় করছি। এভাবে প্রত্যেক ওয়াক্ত কাজা নামাজ আদায় করার সময় নিয়ত করতে হবে। আর ততোদিন পর্যন্ত কাজা নামাজ আদায় করতে থাকবে, যতোক্ষণ না ওই ব্যক্তির মন এ সাক্ষ্য দেবে, তার জিম্মায় কোনো নামা কাজা নেই। এইভাবে কাজা নামাজ আদায় করাকে উমরি কাজা আদায় বলে। কাজা নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো প্রত্যেক নামাজের সময় একাধিক ওয়াক্তের কাজা আদায় করে নেয়া। যেমন কোনো ব্যক্তি আসরের নামাজের আজানের পর সেদিনকার ফরজ নামাজ পড়ার আগে কাজা আসরের নামাজ আদায় করলো পরে সেদিনকার নামাজ পড়লো। এভাবে কাজা নামাজ আদায় করতে করতে একসময় যখন মনে হবে তার আর কোনো নামাজ কাজা নেই। যে ব্যক্তির জিম্মায় কাজা নামাজ রয়েছে, তার জন্য উত্তম হলো নফল নামাজের পরিবর্তে কাজা নামাজ আদায় করা। কেননা, সে কাজা নামাজ সম্পর্কে কেয়ামতের দিন প্রশ্নের মুখে পড়বে, নফল নামাজ সম্পর্কে নয়।
অপর দল আলেমের মতেÑ দীর্ঘকালের অনাদায়ী ফরজ ও ওয়াজিব নামাজের জন্য উমরি কাজা নামাজ আদায় করার প্রয়োজনীয়তা নেই। আলিফ পাবলিকেশন্স (২/৩ প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার) থেকে প্রকাশিত ‘সালাতে রাসুল’ শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছেÑ কাজায়ে উমরি ভিত্তিহীন।
তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা বিগত জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেন। উমরি কাজায় সময় ব্যয় না করে নফল ও তাহাজ্জুদ বেশি বেশি করে পড়া উচিত। কারণ, সহিহ হাদিসে আছে, কারো ফরজ নামাজ কম পড়ে গেলে নফল দ্বারা তা পূরণ করা হবে।
আবু দাউদ। আহলে হাদিস সম্প্রদায় উমরি কাজার বিরুদ্ধাচরণ করছে। ‘পিস টিভি’র আলেমগণ’ উমরি কাজাকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে এবং এই টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে এই ধরনের কথা প্রচার করা হচ্ছে।
তাদের মতে, যে ব্যক্তি বিগত জীবনে দীর্ঘকাল বেনামাজি থেকে অনেক নামাজ কাজা করে ফেলেছে তার উচিৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করা এবং তারপর যথাসময়ে নামাজ পড়ায় যতœবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নফল নামাজ বেশি বেশি করে পড়া। সূত্র: মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ উর্দু ৭৮পৃ., ১নং টীকা, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়া ৫/৩০৬, ১৫/৭৭, ১৬/১০৫, ২০/১৭৪, মিশকাত ৬০৩ নং হাদিসের আলবানির টীকা দ্র.।
আলেমদের মতামত যাই হোক না কেন এগুলো হলো সাবধানতামূলক কর্ম। আশা করা যায়, তওবা ও কাজার মাধ্যমে আল্লাহ তার অপরাধ ক্ষমা করবেন।
লেখক : আলেম ও গণমাধ্যমকর্মী