বর্ণবাদের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলুন
মানিক রক্ষিত
বর্ণবাদের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলুন তামিলনাড়ুর ২৫০ দলিত হিন্দু পরিবার সামাজিক বৈষম্যে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করছেন বলে ইন্ডিয়া টাইমসে খবর প্রকাশ। এভাবে দলে দলে কখনো ইসলাম, কখনো বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মে দলিত হিন্দুরা মুক্তির সন্ধান করেছে। তবুও চেতনার উদয় হয়নি হিন্দু সমাজের তথা নাক উঁচু ব্রাহ্মণদের। বর্ণবাদকে জিইয়ে রাখার নানান ফন্দিফিকির তারা সবসময়ই চালিয়ে এসেছে। বর্ণবাদ ও জাতিভেদ হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় কণ্টকমুকুট। বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজও আমরা এই অভিশপ্ত সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, নব্য সংস্কারবাদীরাও ইনিয়ে বিনিয়ে জাতিভেদের বিরুদ্ধে কথা বললেও বর্ণবাদকে জিইয়ে রাখার পক্ষপাতী। শাস্ত্রের বাইরে তারা যেতে নারাজ।
জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করার মতো শাস্ত্রের নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও ইতিহাস টেনে আনছেন অনেকে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, শাস্ত্রগুলো ব্রাহ্মণদেরই রচনা, তাই তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এখানে নগ্ন হস্তক্ষেপও করা হয়েছে। বর্তমানে যে জাতি-বর্ণবাদ চালু আছে, তা বেদে উল্লিখিত চারটি বর্ণ নয়। হিন্দু সমাজে এখন অসংখ্য (প্রায় শতাধিক) বর্ণ/জাতি রয়েছে। এদেরকে বর্ণ বলা উচিত নাকি জাতি বলা উচিত ব্যাপারটা পরিষ্কার না। সম্ভবত ‘জাত’ বললে উপযুক্ত হয়। এদের কারও সঙ্গে কারও বিয়ে হিন্দুসমাজ স্বীকার করে না। এটা হিন্দুদের মজ্জাগত ‘অপসংস্কার’। অধুনা সংস্কারবাদীদের অনেকে বর্তমান শতধাবিভক্ত মরণাপন্ন হিন্দু সমাজকে বাঁচাতে বেদ-গীতার চারিবর্ণের ব্যাখ্যারূপ পাচন নিয়ে হাজির হচ্ছেন। গীতার মহাবাক্য ‘চাতুর্বরণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ’ (৪/১৩) এটাকেই ব্রহ্মাস্ত্র করছেন। কিন্তু এটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবসম্মত, আর আদৌ এটার প্রয়োজন আছে কি না, তা কি ভেবেছেন? একশটা জাতকে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চারটা বর্ণের অধীনস্থ করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদৌ কি সম্ভব? কে করবে সে কাজ? তারচেয়েও বড় কথা, এই চারটা বর্ণেরই বা আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি সমাজে? কৃপা করে একটু ভাবুন। হিন্দুধর্মে বর্ণপরিচয় জন্মসূত্রেই হয়ে থাকে। গুণ-কর্ম অনুযায়ী নয়। কদাচিৎ শাস্ত্র উল্টে-পাল্টে সামান্য কিছু দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় যাদের বর্ণপরিচয়ের উত্থান বা পতন ঘটেছিল। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম ও বিরল ঘটনা, স্বাভাবিক ঘটনা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে জন্মসূত্রেই হিন্দু তার বর্ণ লাভ করেছে এবং করছে। গুণ-কর্ম অনুযায়ীই যদি বর্ণবিচার হতো তবে ‘বর্ণসংকর’ নামক গুরুতর শব্দটার আবির্ভাব ঘটতো না।
এ বিষয়ে অর্জুনের প্রশ্নে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ গীতার শেষ পর্যন্ত নীরব থেকেছেন। আমরা কোনো উত্তর পাইনি। আজ থেকে বহুকাল আগে বৈদিক যুগে কোনো বর্ণভেদ ছিল না। বেদে চারবর্ণের উৎপত্তিমূলক পুরুষসূক্ত পরবর্তীতে সংযোজন হয়েছিল; সম্ভবত পৌরাণিক বর্ণবাদকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। প-িতদের এমনই ধারণা। পাঁচ হাজার বছর আগে মহাভারতের যুগে আর্য সমাজকে গুণ-কর্ম অনুযায়ী চার বর্ণে ভাগ করা হয়েছিল। সেটা ছিল সরল সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস। কিন্তু আজ থেকে এক হাজার বছর আগেই হিন্দু সমাজকে বহু পেশাভিত্তিক বর্ণে ভাগ করেছেন রাজাগণ। তারপর মধ্যযুগে আরও স্মৃতিশাস্ত্রে অগণিত বর্ণের সৃষ্টি হলো। সমাজ যত জটিল হয়েছে, বর্ণবাদ নামক সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ততই বিকাশ লাভ করেছে। তাই বেদ-গীতার চারবর্ণের ভাঙন হাজার বছর আগেই শুরু হয়েছে। পরে তা বহু পল্লবিত হয়ে হাজার বছরের পরাধীনতার পুষ্পে বিকশিত হয়ে আজকের মৃতপ্রায় হতচ্ছাড়া হিন্দুজাতি রূপ ফল প্রদান করেছে। আমাদের প-িত ব্রাহ্মণগণই বেদ লঙ্ঘনের কাজ শুরু করেছিলেন। এমনকি বেদে অনুমোদিত অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহকেও নিষিদ্ধ করে গেছেন যা এখনও নিষিদ্ধ। কিন্তু এই বিবাহ যৌক্তিক এবং এখনই সর্বাধিক জরুরি।
কোনো বিধানই শাশ্বত নয়। তাছাড়া, প্রাচীনতম স্মৃতিশাস্ত্র মনুসংহিতায় সমাজ ও রাজ্যের সকল বিধান দেওয়ার পরও বলা হয়েছে, যুগের সঙ্গে সময়ের প্রয়োজনে মানুষের কল্যাণে বিধান পরিবর্তিত হতে পারে। তাইতো আমাদের শাস্ত্রের এতো বিবর্তন দেখতে পাই। এজন্যই সনাতন ধর্মকে বলা হয় একমাত্র প্রগতিশীল ধর্ম। মনু আরও একটি কথা সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন : ‘যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানি প্রজায়তে।’ অর্থাৎ যুক্তিহীনভাবে বিচার করলে ধর্মের হানী ঘটে। অতএব, এই সংক্ষিপ্ত ও যৌক্তিক বিচারে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করি : বেদ-গীতার প্রাচীনত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বেদ-পুরাণের যুগে যেমন ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, তেমনি শাস্ত্রে নির্ধারিত বর্ণবাদেরও কোনই প্রয়োজন নেই আধুনিককালে। ধর্মের মূল কথা হলো মঙ্গলময় জীবন ও আধ্যাত্মিকতা। জীবনের চার উদ্দেশ্যÑ ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ কোনোটির জন্যই বর্ণবাদ জরুরি নয়। বর্ণবাদ একটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস মাত্র। এর বর্তমান আবেদন শূন্য নয়, বরং নেতিবাচক। তাই ইনিয়ে-বিনিয়ে বর্ণবাদকে সমর্থন করার মতো কোনো সুমিষ্ট ফল এটা আদৌ নয়। এই অভিশপ্ত বিষবৃক্ষকে সমাজ থেকে দ্রুত উৎপাটন করতে হবে। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র আরও যত বাহারি জাত-পাত আছে সব বর্ণবিচার চিরকালের জন্যই বন্ধ করতে হবে। গুণ-কর্ম অনুযায়ী মানুষকে যাচাই করতে হবে, বর্ণ বা জাত নয়। সবকিছুর উর্ধ্বে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটাই পরিচয় হতে হবে ‘হিন্দু’।
লেখক : সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়