বিশ্বভ্রাতৃত্ব, শান্তি ও সনাতন ধর্ম
রবিন কুমার সাহা
সনাতন ধর্ম কোনো সংকীর্ণ গোষ্ঠীর মতাদর্শ নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৫/৭) বলেছেন, মামৈবাংশ জীবলোকে জীবভূত সনাতন, প্রতিটি জীবই আমার নিত্য ও সনাতন অংশ। সুতরাং, এটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সনাতন ধর্ম প্রতিটি জীব, এমনকি গাছপালা প্রভৃতি আচ্ছাদিত চেতন জীবেরও নিত্য ধর্ম। আমরা বলতে পারি না যারা ‘অমুক গ্রন্থ, অমুক মত, অমুক নিয়ম’ প্রভৃতি মানে, তারাই সনাতন ধর্মাবলম্বী। আর যারা মানে না, তারা বিধর্মী। কেউ হয়তো, এটা স্বীকার নাও করতে পারে। এতে কিছু যায় আসে না। আমরা যদি ভগবানের বাক্য স্বীকার করি, তবে এটা স্বীকার করতেই হবে। সন্তান যদি পিতাকে অস্বীকার করে তবে পিতা-সন্তানের সম্পর্কের সত্য বা বাস্তবতা মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি সৃষ্টিই ভগবানের নিত্য অংশ।
তাই, আমাদের ভ্রাতৃত্ব কোনো সংকীর্ণ গোষ্ঠীর জন্য হতে পারে না। আমরা কল্যাণ কামনা করি প্রতিটি জীবের জন্য। আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাবলিতে আমরা যেসব প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকি, সেগুলোতেও রয়েছে সেই সনাতন ভ্রাতৃত্বের ছাপ। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই আমরা প্রার্থনা করে থাকি উপনিষদের শান্তিমন্ত্র।
ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভির্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ॥ (শান্তিপাঠ, প্রশ্নোপনিষদ)
অর্থাৎ, হে দেবগণ, আমরা কর্ণ দ্বারা যেন কল্যাণপ্রদ বাক্যসমূহই শ্রবণ করি। হে যজনীয় দেবগণ, আমরা চক্ষু দ্বারা যেন মঙ্গলকর বিষয়সমূহই দর্শন করি। স্থির দৃঢ় শরীর ও অবয়বের দ্বারা তোমাদের স্তুতি করে যেন দেবগণের বিহিত আয়ু লাভ করি। আমাদের (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক) ত্রিবিধ তাপের যেন শান্তি হয়। এখানে আধ্যাত্মিক তাপ বা দুঃখ বলতে বোঝায় নিজ হতে প্রাপ্ত দুঃখসমূহ। আধিদৈবিক তাপ হচ্ছে দৈববশত যেসব ক্লেশ আমাদের জীবনে আসে। যেমনÑ ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প প্রভৃতি। আধিভৌতিক তাপ বলতে অন্যান্য জীব হতে প্রাপ্ত দুঃখসমূহ।
কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য শান্তি কামনা করে সারাবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। দেহের একটি অংশে ক্যান্সার থাকলে অন্য অংশগুলো নিজেদের ভালো থাকার কথা জাহির করতে পারে না। সনাতন শাস্ত্রের কোথাও ঘটা করে নিজেদের গোষ্ঠীর কল্যাণ কামনা করতে অনুপ্রাণিত করেনি। কারোর প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব নয়, সকলের প্রতি শুভকামনাই জগতে শান্তির বার্তা প্রদান করতে পারে। বিদ্বেষভাব ডেকে নিয়ে আসে ধ্বংস ও পাশবিকতা। সনাতন শাস্ত্রগুলোও তাই সকল জীবের এমনকি শত্রুর পর্যন্ত কল্যাণ কামনা করতে শেখায়।
স্বস্ত্যস্তু বিশ্বস্য খলঃ প্রসীদতাং ধ্যায়ন্তু ভূতানি শিবং মিথো ধিয়া।
মনশ্চ ভদ্রং ভজতাদধোক্ষজে আবেশ্যতাং নো মতিপ্যহৈতুকী ॥ (ভাগবত ৫/১৮/৯)
-হে ভগবান, নিখিল বিশ্বের মঙ্গল হোক, দুষ্ট ও খল ব্যক্তিগণ ক্রুরতা ত্যাগ করুন, জীবেরা পরস্পরের মঙ্গলচিন্তা করে শান্ত হোক। আমরা যেন অধোক্ষজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন হয়ে সর্বদা তার সেবায় যুক্ত থাকতে পারি। উদ্ধৃত শ্লোকটি শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধে ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের কাছে ভক্তশ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদ মহারাজ প্রার্থনা করেছেন। এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, ‘জড়জগৎ মাৎসর্য পরায়ণ ব্যাক্তিতে পূর্ণ। কিন্তু কেউ যখন নির্মৎসর হন, তখন তার সামাজিক আচরণ উদার হয় এবং তিনি অন্যদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেন।… তাই আমাদের কর্তব্য ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের কাছে প্রার্থনা করা, ‘হে নৃসিংহদেব আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে অবস্থান করে, আমার সমস্ত অসৎ প্রবৃত্তি সংহার করুন। আমার মন সর্বতোভাবে নির্মল হোক, যাতে আমি প্রশান্তচিত্তে আরাধনা করতে পারি এবং সারা জগতে শান্তি আনয়ন করতে পারি।’
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাবি