জুলাইতে আ.লীগের ১৫ নেতাকর্মী নিহত
এম কবির : দলীয় পদ-পদবি, চাঁদার টাকা ভাগাভাগিসহ নানা কারণে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। খুন আতঙ্কে ভুগছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কখন কে কোথায় কীভাবে আক্রান্ত হন সে আশঙ্কায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছে তারা। রাজধানীসহ সারা দেশের চিত্র প্রায় একই। এসব হত্যাকা-ের নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার।
গত ১ জুলাই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারিতে মংশৈলু মারমা (৫৬) নামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। মংশৈলু মারমা বাইশারি ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। পরিবারের সন্দেহ, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হয়।
গত ২ জুলাই ফরিদপুরের নগরকান্দায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তিহারউদ্দিন মাতুব্বরকে (৬০) গুলি করে এবং কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া ইউনিয়নের বিনোকদিয়া বাজারের কাছে এ হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এ সময় তিহারউদ্দিন মাতুব্বরের ভাই নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য সাহিদ মাতুব্বরকেও কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। নিহত তিহারউদ্দিন মাতুব্বর সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং গট্রি ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
৩ জুলাই ঝালকাঠির নলছিটিতে সজল হাওলাদার (১৮) নামের এক ছাত্রলীগকর্মীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার মালুহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত কক্ষে নিয়ে তাকে গুলি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। নিহত সজল মোল্লারহাট জেডএ ভূট্টো ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি পশ্চিম কামদেবপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম তুজাহার হাওলাদারের ছেলে। মোল্লারহাট ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সজল।
৩ জুলাই মাত্র ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে কক্সবাজারে হত্যা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে। তাদের কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের একজন হচ্ছেন মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এক সময়ের আলোচিত জলদস্যু সম্রাট আবদুল গফুর ওরফে নাগু মেম্বার (৬৫) এবং অন্যজন হচ্ছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম (৬৮)।
অপরদিকে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য সিরাজুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করেছে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তার স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার।
সদর ইউনিয়নের পল্লানপাড়ার তিন রাস্তার মাথা এলাকায় বাড়িতে ঢুকে সন্ত্রাসীরা সিরাজুল ইসলামকে গুলি করে। আহতকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।
৪ জুলাই টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নের গনিপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ নামে এক আওয়ামী লীগকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে প্রতিবেশী দুই ভাই। গোপালপুর থানার ওসি মোহাম্মদ আব্দুল জলিল জানান, রোপা আমন চারা ক্ষেতে গরু যাওয়ার ঘটনায় কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে আব্দুল আজিজকে একই গ্রামের আজগর আলী ও তার ভাই জুলহাস উদ্দীন মারপিট করে। স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। ঘটনার পর গ্রামবাসী ওই দুই ভাই আজগর ও জুলহাসকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
৪ জুলাই যশোরের ঝিকরগাছায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে হাসান আলী (৪৮) নামে এক আওয়ামী লীগকর্মী নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন ভোররাতে দুর্বৃত্তরা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। হাসান ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি মঠবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। ঝিকরগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোল্লা খবির আহমেদ জানান, ভোররাতে দুর্বৃত্তরা আওয়ামী লীগকর্মী হাসানের বাড়িতে গিয়ে তাকে ডেকে তুলে গুলি করে। ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় বিরোধের জের ধরে হাসান আলী নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে। নিহত হাসান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি রবিউল হত্যাসহ একাধিক হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
৮ জুলাই মাগুরার শালিখা উপজেলায় জলিল মোল্লা (৫০) নামে এক আওয়ামী লীগকর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। উপজেলার চটকাবাড়ীয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জলিল মোল্লা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নটুয়াপাড়া গ্রামের আব্দুল গফুর মোল্লার ছেলে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
৮ জুলাই রাজধানীর সূত্রাপুর ও মাগুরার শালিখায় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রাজধানীর সূত্রাপুর থানার ধোলাইখালের রোকনপুরে রাজীব হাসান (৩৮) নামের এক যুবলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পরিবার পরিজন জানিয়েছেন, রাজীব হাসান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের উপ-অর্থ সম্পাদক ছিলেন।
এদিকে, মাগুরার শালিখা উপজেলায় জলিল মোল্লা (৫০) নামে এক আওয়ামী লীগকর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
৯ জুলাই ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার নাটোপাড়া গ্রামের দলীয় প্রতিপক্ষের হামলায় জলিল মোল্লা (৫০) নামে এক আওয়ামী লীগকর্মী নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে দলীয় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা তাকে লোহার রড ও ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। স্থানীয়রা উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। নিহত জলিল মিয়া ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নাটোপাড়া গ্রামের আব্দুল গফুর মোল্লার ছেলে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
১০ জুলাই বাসা ভাড়া নিয়ে বিরোধের জের ধরে সিলেট স্বেচ্ছাসেবক লীগের আব্দুল্লা অন্তর (২২) নামে এক কর্মীকে খুন করা হয়েছে। সদর উপজেলার তারাপুর চা বাগানের কাছে গোয়াবাড়ি নেহার মঞ্জিলে এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে।
সিলেট মহানগরীর জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন জানান, স্বেচ্ছাসেবক লীগকর্মী সানির মালিকানাধীন নেহার মঞ্জিলে ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকতেন অন্তর। ভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণে গতকাল সানির নেতৃত্বে অন্তরের উপর হামলা চালায় তেলীহাওর গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মীরা। একপর্যায়ে অন্তরকে ছুরিকাহত করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ জানায়, নিহত অন্তর সিলেট সিটি করপোরেশনের ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব হোসেনের সমর্থক ছিলেন।
২০ জুলাই শরীয়তপুরের নড়িয়ার জবসা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান শওকত আলীর লোকজন জাকির হোসেন হাওলাদার নামে আওয়ামী লীগেরই অপর গ্রুপের কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ঘটনার দিন বুধবার রাত ১১টার দিকে জবসা ইউনিয়নের চরভোজেশ্বর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
২২ জুলাই পাবনা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় স্বচ্ছাসবেক লীগ নেতা আমিন উদ্দিন (২৬)-কে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার দিন রাত দশটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আমিন পাবনা পৌর সদরের দোহারপাড়া এলাকার বাবলু হোসেনের ছেলে।
২৪ জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক যুবলীগকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। নিহত লিটন পন্ডিত (৩৫) মঠবাড়িয়া পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমির হোসেনের পুত্র। তিনি মঠবাড়িয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক আশ্রাফুর রহমান পক্ষের লোক বলে পরিচিত।
৩০ জুলাই পূর্ব বিরোধের জের ধরে নাটোরের লালপুরে আব্বাস আলী (৩৫) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষরা। এসময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জমির উদ্দিন নামের অপর একজন আহত হয়েছে। আহত জমির উদ্দিনকে উপজেলা স্বাস্থ্য বমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। গত শনিবার রাত ৮টার দিকে উপজেলার এবি ইউনিয়নের বরমহাটি এলাকায় এঘটনা ঘটে।
আহত অবস্থায় আব্বাস আলীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। নিহত আব্বাস আলী এবি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও মৃত বলাই উদ্দিন শেখের ছেলে। লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু ওবায়েদ ও স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই আব্বাস আলী ও মিজান গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ