সার্কের পাঁচ দেশে ভয়াবহ বন্যা
প্রিয়াংকা আচার্য্য : দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (সার্ক) দেশÑ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশ এবং সার্কের পর্যবেক্ষক দেশ চীনে প্রবল বর্ষণের ফলে সৃষ্ট মৌসুমি বন্যায় এ পর্যন্ত ৪ শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। গৃহহীন হয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। এ বন্যায় পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সংকটও রয়েছে দুর্গত এলাকার মানুষদের।
বাংলাদেশ : দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। একই সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় দুর্ভোগ চরমে। রৌমারী স্থলবন্দর ও সীমান্ত হাটও তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে চাল, নগদ অর্থ ও শুকনা খাবার বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বন্যাকবলিত হয়েছে ১৬ জেলার ৫৯ উপজেলা। ১৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। জেলাগুলোর ৩০৯টি ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৬টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৫ জন। ৯ হাজার ৯১৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ১২ হাজার ৩৭১টি। বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৬টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ধ্বংস ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৮৮টি। ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৬৯টি। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত লোকসংখ্যা ৭ হাজার ৩৭৫ জন।
জানা গেছে, বর্তমানে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, পদ্মা, ঘাঘট, করতোয়া এবং সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ১৭টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ার সময় দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
ভারত
ভয়াবহ বন্যা চলছে ভারতে। বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ জনে। আসাম, বিহার, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে ৩২ এবং উড়িষ্যা রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের।
গতকাল রোববার বিহার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর জানায়, রাজ্যের ১২টি জেলার প্রায় ২৭ লাখ মানুষ এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৩.৩৭ লাখ হেক্টর ক্ষেতের ফসল বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। আসামে ২২টি জেলার ৩ হাজার গ্রামের প্রায় ১৯ লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আবহাওয়া দফতরের বরাত দিয়ে গত ২৪ বছরের মধ্যে চলতি বছরের বন্যাকে আসামের সবচেয়ে ভয়াবহ বলে ব্যাখ্যা করেছে সংবাদমাধ্যমগুলো।
আসামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ভেসে গেছে অরুণাচল ও ভুটানসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা। খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শনিবার সকালে আসামের ধুবড়ি এবং চিরাং জেলার বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ স্যান্যাল। এছাড়া ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও গতকাল বিমানে বন্যা পরিস্থিতি দেখেন। এরপর তিনি আসামের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে একটি বৈঠক করেন।
বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে এরই মধ্যে নেমে পড়েছে এনডিআরএফ, এসডিআরএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী। চলছে বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজ। ব্যাঙ্গালুরুতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
নেপাল
বর্ষায় নেপালে বন্যা এবং বন্যার ফলে সৃষ্ট ভূমিধসে এ পর্যন্ত মারা গেছে ১১১ জন, নিখোঁজ ২১ জন, ৯ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত ও ১২শর মতো বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দৈনিক দ্য পেনিনসুলা। এছাড়া ভূমিধসে রাস্তা ও ব্রিজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাজারো মানুষ বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়ে দুঃষহ দিন যাপন করছে। নেপালে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী। পশ্চিমাঞ্চলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। নেপালি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকে মৃতের খবর আসছে।
পাকিস্তান
পাকিস্তানেও বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গতকাল রোববার দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে গ্লোব গেজেট জানিয়েছে, জুলাই মাসে বন্যা শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৮২ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার পেশোয়ারের একটি পার্বত্য সড়কে বন্যার পানিতে বরযাত্রীবাহী পিকআপ ভ্যান ভেসে গিয়ে ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানিয়েছে এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। নিহতদের মধ্যে ১৮ জন নারী ও শিশু।
চীন
১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে চীন। ভারী বর্ষণের কারণে একদিকে বন্যা, অন্যদিকে ভূমিকম্পে দেশটিতে ২ শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে চীন। চীনের বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ। যেখানে ২৩০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক লোকসান গুনতে হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, যার আর্থিক লোকসানের আকার প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যা একটি নিয়মিত ঘটনা। প্রতি বছরই এতে কয়েকশ লোক প্রাণ হারায়। সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট, গ্লোব গ্যাজেট, দ্য পেনিনসুলা, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস। সম্পাদনা : এম আলম