বঙ্গবন্ধু আমাদের পথ-প্রদর্শক
মিল্টন বিশ্বাস
কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকা-ের পটভূমি বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে। মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মীতা, বক্তব্য, তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুরই দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মীতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য সামাজিক মানুষের হৃদয়ে প্রবেশে তার কষ্ট করতে হয়নি। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ-সরল মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; তাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। গান্ধীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রভাব জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, চেতনাকে করেছিল পরিশুদ্ধ, ধারণা দিয়েছিল পাল্টে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কবিতার মুখ্য উপাদান। ১৯৮২ সালে নির্মিত জরপযধৎফ অঃঃবহনড়ৎড়ঁময- এর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রটি পৃথিবীব্যাপি মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ইংরেজিতে লেখা মুলক রাজ আনন্দ, রাজা রাও, আর কে নারায়ণের উপন্যাস পড়ে এ ছবির নির্মাতা গল্পের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এধরনের ছবি বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়নি। তবে গান্ধী যেমন ভারতের ভাষা-সাহিত্যকে নতুন উদ্দীপনায় মুখরিত করেছিলেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বঙ্গবন্ধু তার চিন্তা ও জীবনযাপন দিয়ে সচকিত করে তুলেছিলেন। তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা গল্পের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত পরিস্থিতি, তার রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের জন্য ত্যাগের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তার মৃত্যু ছিল হাহাকারের; সেই অবস্থা তুলে ধরেছেন সাহিত্যিকরা। যদিও কোনো গল্প-উপন্যাসে ‘মুজিববাদে’র অনুপুঙ্খ রূপায়ণ নেই তবু একটি ‘আদর্শ বাঙালি রাজনৈতিক’ জীবনকে কেন্দ্র করে প্রভূত আখ্যান গড়ে উঠেছে। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে লোকায়ত মানসে মুজিব চিরন্তন হয়ে ওঠার কাহিনীও তৈরি হয়েছে। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। সাধারণ জনতার কাছে তার পৌঁছে যাওয়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তার চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তার জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তার অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে তারা ১৯৭৭ সালের পর সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সংগোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদগম হয়েছে। ধনী থেকে গরিব, জ্ঞানী থেকে নিরক্ষর তাকে কেন্দ্র করে রচিত ও পরিবেশিত গানের মুগ্ধ শ্রোতা এখনও। যে জনতা নয় মাসের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে ১৫ আগস্টের পরে সেই দেশবাসীর প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ টের পেয়েছিলেন সকলে। অসহায়, দুখী, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাকে সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে হয়েছিল।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন